মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর • জমির শ্রেণি পরিবর্তনে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বাড়তি ৮৭ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে
ভূঁইয়া নজরুল »
নাল (পতিত) জমি না লবণ মাঠ? এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে এসেছে মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত স্থানীয় অধিবাসী ও জেলা প্রশাসনের সাথে। অবশেষে স্থানীয় বাসিন্দাদের জয় হয়েছে।
নাল জমি ও লবণ মাঠ জমি বিতর্ক নিরসনে ভূমি মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে লবণ মাঠ হিসেবে বিবেচিত হয় মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমি। আর এতে ভূমির অধিগ্রহণ মূল্য আরো ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ টাকা বেড়ে যায়।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘লবণ মাঠে আটকে আছে গভীর সমুদ্রবন্দর’ শীর্ষক প্রতিবেদন সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
ভূমির অধিগ্রহণ মূল্য বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হবে স্থানীয় প্রায় ২০০ পরিবার। অধিগ্রহণ মূল্য বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে স্থানীয় ধলঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগের দর অনুযায়ী একরপ্রতি মূল্য পেয়েছিলাম ২৪ লাখ টাকা, এখন শ্রেণি পরিবর্তন হওয়ায় একর প্রতি পেয়েছি ৫৫ লাখ টাকা করে। আর এই টাকা মাতারবাড়ি এলাকায় অন্য যেকোনো প্রকল্পে অধিগ্রহণের মূল্যের চেয়ে বেশি। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পে একর প্রতি দাম ছিল ৩৩ লাখ করে।’
সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে মাতারবাড়ি প্রকল্পে এখন অধিগ্রহণ মূল্য বাড়লো কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমত এর আগে এই জমি নাল হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য প্রকল্পেও নাল হিসেবে রেকর্ড হওয়ার পর কিছু টাকা থোক হিসেবে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পে আমরা জমির শ্রেণির পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছি। আন্দোলনের কারণে সরকার জমির শ্রেণি পরিবর্তন করেছেন এবং বেশি দাম পাওয়া গেছে। এতে প্রায় ২০০ পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারবে।
জমির শ্রেণি পরিবর্তন কেন হলো?
মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য প্রথম দফায় ২৮৩ দশমিক ২৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য চূড়ান্ত হয় গত মে মাসে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধিগ্রহণবাবদ ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকা চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে টাকা জমাও দিয়েছিল। কিন্তু অধিগ্রহণবাবদ এই মূল্য নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা নাল জমির পরিবর্তে এই এলাকার জমিকে লবণ মাঠ হিসেবে নথিভুক্ত করার জন্য তদবির ও আন্দোলন শুরু করে।
স্থানীয়দের দাবির মুখে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে যৌথ তদন্তের মাধ্যমে নাল শ্রেণির পরিবর্তে মাঠ শ্রেণি হিসেবে গণ্য করে ভূমির মূল্য নির্ধারণ করতে পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করা হয় গত ২৪ আগস্ট। সেই কমিটি গত ২৯ আগস্ট মাতারবাড়ি বন্দর এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে চিংড়ি ও লবণ মাঠের প্রমাণ পায়। এসব ভূমি বছরের ছয় মাস লবণ চাষ ও বাকি ছয় মাস চিংড়ি চাষ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে স্থানীয়রা তদন্ত কমিটির সামনে তাদের অভিমত প্রকাশ করে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (অধিগ্রহণ-২ অধিশাখা) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের রিপোর্টের পর তিন মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভূমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়।’
অধিগ্রহণ মূল্য অতিরিক্ত আরো ৮৭ কোটি ৪৬ টাকা
এদিকে জমির শ্রেণি পরিবর্তন চূড়ান্ত হওয়ায় গত ৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ স্বাক্ষরিত আদেশে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত আরো ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ দশমিক শূন্য এক টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। একইসাথে বলা হয়েছে পূর্বের নাল শ্রেণির জমিকে লবণমাঠ/মাঠ হিসেবে সংশোধন করে ভূমির মূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ভূমির মূল্য পরিবর্তন করা হয়েছে। আর এতে আগের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে। তবে স্থানীয়রা লাভবান হবে।’
এর আগে কক্সবাজারে লবণ মাঠ হিসেবে কোনো ভূমি রেকর্ড করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯১৭ সাল থেকে লবণ মাঠের পরিবর্তে নাল জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য বেশি ছিল। তাই স্থানীয়দের অধিক মূল্য দিতে নাল হিসেবে রেকর্ড করতাম। তবে এখন লবণ মাঠের শ্রেণির অধিগ্রহণ মূল্য বেশি তাই স্থানীয়রা বেশি টাকা পাবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
২৮৩ দশমিক ২৭ একর ভূমি আগে যেখানে ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকা তিরাশি পয়সায় পাওয়ার কথা ছিল, এখন এর সাথে আরো যুক্ত হচ্ছে ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ দশমিক শূন্য এক টাকা। ফলে অধিগ্রহণবাবদ মোট মূল্য পরিশোধ করতে হবে ১৬২ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ২৭১ দশমিক ৮৪ টাকা। এই বাড়তি টাকা পরিশোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে হবে দ্রুত। ভূমির মূল্য পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। তাই অর্থ পরিশোধে সমস্যা হবে না।’
উল্লেখ্য, মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। ইতিমধ্যে ১৪ মিটার ড্রাফট করাও হয়েছে আগামীতে ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ এর আওতায় ড্রাফট ১৬ মিটারে উন্নীত করা হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত এই প্রকল্পের বাজেট ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। দেশে দিন দিন আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এই বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা ৯ দশমিক ৫ মিটার। তাই বড় দৈর্ঘ্য ও বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়াতে মাতারবাড়ির বিকল্প নেই। মাতারবাড়ি চালু হলে এর সাথে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে নেটওয়ার্ক আরো বাড়বে। কারণ বড় জাহাজগুলো মাতারবাড়িতে পণ্য নিয়ে আসবে। সেখান থেকে ছোটো জাহাজে করে দেশের অন্যান্য বন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে। ফলে গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ি বন্দর।