নিলা চাকমা »
চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। প্রতিবছর গড়ে আড়াই থেকে ৩ হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী শুধু চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে গত বছর চার শতের বেশি রোগী জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু ব্র্যাকি থেরাপি দেয়ার মেশিনটি অচল ১ বছর ধরে। এজন্য ৮০ শতাংশ জরায়ু ক্যান্সার রোগীদের ছুটতে হয় ঢাকায় কিংবা দেশের বাইরে। এছাড়া প্রতিরোধমূলক এইচপিভি টিকা সরকারিভাবে দেওয়া হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের স্ক্রিনিং করার বিষয়ে কোনো প্রচারণা নেই। ফলে আক্রান্তদের চিকিৎসায় পোহাতে হচ্ছে বিভিন্ন ভোগান্তি।
চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে চমেক হাসপাতালে স্তন ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সারসহ মোট ২ হাজার ৯৩০ জন ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়েছেন। তার মধ্যে ৪১০ জন অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ১৪ শতাংশ জরায়ু মুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী ছিলেন। ২০২১ সালে সেই সংখ্যা ছিলো প্রায় সাড়ে তিনশ’। জরায়ু ক্যান্সার রোগীদের দু’ভাবে চিকিৎসা দিতে হয়। রেডিওথেরাপি এবং ব্র্যাকি থেরাপি। কোনো রোগীকে সার্জারি করাতে হয়, কোনো কোনো রোগীকে রেডিওথেরাপি এবং ব্র্যাকি থেরাপি দুটাই দিতে হয়। তবে জরায়ু ক্যান্সার রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশকে ব্র্যাকি থেরাপি দিতে হয়। কিন্ত চমেক হাসপাতালে সেই ব্র্যাকি থেরাপি মেশিনটি ১ বছর ধরে অচল। গত বছরের ৬ জুন থেকে এটি অচল হয়ে হয়ে পড়ে আছে। এই মেশিনটি চট্টগ্রামে আর কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নেই। বাধ্য হয়ে জরায়ু ক্যান্সার রোগীদের ঢাকা গিয়ে ব্র্যাকি থেরাপি দিতে হয়।
ব্র্যাকি থেরাপি মেশিনটি ২০১৯ সালের মে মাসে স্থাপন করা হয়। সেবা চালু হওয়ার পর ২০১৯ সালে ৫৫ জন, ২০২০ সালে ৩৫ জন, ২০২১ সালে ১৬১ জনসহ মোট ২৫১ জনকে ব্র্যাকি থেরাপি দেওয়া হয়। যার ৭০ শতাংশ জরায়ু ক্যান্সার রোগী ছিলেন। এই থেরাপি সরকারিভাবে ১৫০০ টাকা এবং বেসরকারিতে ১১-১৫ হাজার টাকা গুনতে হয়।
চমেক হাসপাতালে ৪ জুন চিকিৎসা নিতে আসেন সাজেদা বেগম নামে এক মহিলা। তার স্বামী মারা যান ১০ বছর। একমাত্র ছেলে দিনমজুরের কাজ করেন। ১ বছর আগে জানতে পেরেছেন তিনি জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। এতদিন প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন। তবে সেদিন চিকিৎসক ৩টি পরীক্ষা করাতে বলেন। তারমধ্যে একটি চমেক হাসপাতালে। অন্য দুটির মধ্যে একটি পরীক্ষা এভারকেয়ারে এবং অন্যটি ঢাকায় গিয়ে করতে হবে। ব্র্র্যাকি থেরাপি দিতে ঢাকায় যেতে পরামর্শ দেন চিকিৎসক। কিন্তু তার পক্ষে আর চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন- ‘নামেই সরকারি হাসপাতাল। সব চিকিৎসা তো বাইরে থেকে করতে হচ্ছে। ’
সাজেদাকে পরিবারে কিশোরীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে কিনা, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের স্ক্রিনিং করানো হচ্ছে কি? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমিতো জানি না এ সব বিষয়ে। ঠিক সময়ে টিকা নিলে এই রোগ হয় না, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের নিয়মিত স্ক্রিনিং করতে হয় তা জানা নেই। এতদিন চিকিৎসা নিচ্ছি- এ ব্যাপারে কোনো চিকিৎসক পরামর্শ দেননি। জানলে আমাদের মেয়েদের অন্তত সচেতন করতে পারতাম।
জরায়ুর ক্যান্সার ঠেকাতে সরকার ২০১৬ সালে এইচপিভি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়। এটির মাধ্যমে ৯- ১৩ বছরের কিশোরীদের মাঝে এইচপিভি টিকা প্রদান করা হয়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. সুমন বড়–য়া বলেন- ‘দীর্ঘদিন ধরে এই প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কতজনকে টিকা দেওয়া হয়েছে সেই সংখ্যা এখন হাতে নেই। খুব বেশি হবে না সেই সংখ্যা। তবে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার ৭৩৪ জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীকে স্ক্রিনিং করানো হয়েছে। মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য।’
এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালে রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা। তার অন্যতম কারণ কিশোর বয়সীদের টিকা আওতায় না আনা। এছাড়া অল্প বয়সে বাচ্চা প্রসব, বহুগামিতা, জন্মবিরতিকরণ পিল খাওয়াসহ নানা কারণও রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের স্ক্রিনিং করা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা নেই। অনেক নারী জানেই না এই রোগ নিয়ে। অথচ একটু সচেতন হলে নীরবঘাতক রোগটি নির্মূল করা সম্ভব।
যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের পরিবারের মেয়েদের কেন টিকা নিতে ও নিয়মিত স্ক্রিনিং করতে পরামর্শ দেওয়া হয় না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এতো রোগীর চাপ থাকে, আলাদা করে কথা বলার সময় হয়ে উঠে না।
তিনি আরও বলেন, যদি প্রতিটি অফিস-আদালতে, বিদেশ গেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে স্ক্রিনিং বাধ্য করা হতো, তাহলে অন্তত মেয়েরা সচেতন হতো। এতে জরায়ু ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা কমে আসতো।
ব্র্যাকি থেরাপি সচল করার ব্যাপারে জানার জন্য চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।