নিজস্ব প্রতিবেদক »
আর কয়েকদিন পর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। বন্দরনগরীতে শেষ সময়ে জমে উঠেছে পূজার বাজার। কেনাকাটার জন্য পোশাক ও কসমেটিক্সের দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। তার মধ্যে ডলার, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ইস্যু টেনে দোকানিরা চড়া দাম হাঁকাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে ক্রেতাদের মাঝে।
জানা গেছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে ১ অক্টোবর। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে পোশাকের বাজার। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গতবারের চেয়ে এবার বিক্রি ভালো হচ্ছে।
এদিকে পূজা উপলক্ষে কেনাকাটায় বিশেষ ছাড় দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিশেষ কালেকশন নিয়ে এসেছে ফ্যাশন হাউসগুলো।
নিউ মার্কেটের ট্রাফিক, ডিম্যান্ড, এয়ার বি সেন্ট, চারলতা টাঙ্গাইল শাড়ি, রুপের হাট, শাড়ীকা, বাঙ্গালি বাবুসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে এসেছে নতুন কালেকশন। দিচ্ছে বিভিন্ন ছাড়।
পূজা উপলক্ষে কাপড়ের মার্কেট ও শোরুমগুলোতে নারীদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন রংয়ের থ্রি-পিস, জামদানি শাড়ি, কাতান শাড়ি, লেহেঙ্গা ও তাঁতের শাড়ি। ছেলেদের জন্য রয়েছে বাহারি ডিজাইনের ধুতি, শর্ট পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট। তাছাড়াও জুতার দোকানগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন রকমের জুতা। রয়েছে বাচ্চাদের বাহারি পোশাক।
বন্দরনগরীর রিয়াজউদ্দীন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, নিউ মার্কেট, লাকী প্লাজা, মতি টাওয়ার, টেরি বাজার, ফিনলে স্কয়ার, মিমি সুপার মার্কেট, আখতারুজ্জামান সেন্টার, সানমার ওশান সিটি, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, আফমি প্লাজা, ইউনেস্কো সিটি সেন্টার, কেয়ারি ইলিশিয়ামে ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়।
সোমবার বিকেলে টেরিবাজার, নিউমার্কেট, আফমি প্লাজা, সানমারে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের দোকানগুলোতে চলছে কেনাবেচা। মার্কেট ঘুরে দেখা যায় কেউ শাড়ি কিনছে, কেউ পাঞ্জাবি, কেউ আবার কিনছে জুতা। প্রায় সবার হাতেই ছিল শপিং ব্যাগ। প্রতিটি দোকানেই ছিল ক্রেতা।
শিল্পী কর্মকার, চকবাজার থেকে এসছেন টেরিবাজারে। তিনি বলেন, দোকানদাররা সবকিছুর দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। দুর্গাপূজায় তো বাচ্চারা মানছে না তাই কিনতে আসা। ৬০ টাকার এক গজ কাপড় নিচ্ছে ৮৫ টাকায়। যে থ্রি-পিস ২০০০ টাকায় পাবো তা বলছে ৫০০০ টাকা।
আরেক ক্রেতা শিউলী দাশ বলেন, পরিবারের সবার জন্য কাপড় কিনতে আসলাম। এবার পূজা গ্রামে করবো। তিনি বলেন, ‘মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য ধুতি-পাঞ্জাবি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া ছোটদের জন্য জুতা কিনেছি। তবে গতবারের চেয়ে ৩০ শতাংশ দাম বেশি মনে হয়েছে এবার।’
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী টুম্পা শর্মা বলেন, আগে সনাতনীরা এত শপিংমল মুখী ছিল না। সাদামাটা ছিল তাদের জীবন। আজকাল আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের শো অফ বেড়ে গেছে। এখনকার আনন্দ আর নিরপেক্ষ নেই। দেখা যাবে বিজয়া দশমীতে কেউ দামি পোশাক পড়ে ঘুরছে আর নিম্ন আয়ের মানুষরা নীরব থেকে নীরবতর হবে। এই একপক্ষের শো অফের অন্যপক্ষের উপর পড়বে। এতে আগে অল্পতেই খুশি হয়ে পূজার যে আমেজ ছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে। একপক্ষ কেমন যেন প্রতিযোগিতায় নামছে।
নিউ মার্কেট ট্রাফিকের স্বত্বাধিকারী এম ডি ইফতেখার বলেন, আমাদের এই শাখা নতুন খোলা হয়েছে, নিউমার্কেটও শাখা আছে। গতকাল থেকে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে। নতুন হিসেবে তরুণদের সাপোর্ট পাচ্ছি ভালো। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে ৫৯০ টাকায় পাঞ্জাবি দিচ্ছি যা আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে তৈরি করা। আমরা চাচ্ছি কাস্টমার যেন আমাদের থেকে ভালো সেবা পায়। যেসব ক্রেতারা আমাদের পোশাক কিনেছে তারা কম্পোর্ট ফিল করছে। আশাকরি ক্রেতাদের ভালোবাসা পাবো।
টেরিবাজারের নাহার ম্যানশনের স্বত্বাধিকারী মো. ইলিয়াছ বলেন, গত বছরের চেয়ে এই বছর ভালো বিক্রি হচ্ছে। দুইদিন ধরে যে ক্রেতারা আসতেছে তার ৮০ শতাংশ পূজা উপলক্ষে কিনতে এসেছে।
টেরিবাজারের ছৈয়দ আহমেদ মার্কেটের প্রীতম গার্মেন্টসের এডমিন রুপন দাশ বলেন, বিক্রি ভালো হচ্ছে তবে লোডশেডিংজনিত সমস্যায় আছি। রোববার বিদ্যুৎ গেল এখনো আসেনি। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করলে বলে ‘আসছি আসছি’, কিন্তু তারা আসে না।
শান্তি বাবু বেডিং স্টোর ও মীরা গোল্ড প্লাস অ্যান্ড শাড়িজের স্বত্বাধিকারী নারায়ণ দাশ নারু বলেন, ব্যবসা এখনো ভালোভাবে জমে উঠেনি। কিভাবে জমবে! যখন ক্রেতারা আসবে তখন দোকান বন্ধ করতে হয়। রাত আটটা বাজলে দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। বিদ্যুৎয়ের অবস্থা আরো খারাপ। দিনে ৫/৬ লোডশেডিং হয়। কোনকিছুর দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছি না। ক্রয়মূল্য থেকে কয়েক টাকা লাভে বিক্রি করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রাখতে চায় বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
নিউমার্কেটর চারুলতা টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্বাধিকারী মো. জুয়েল বলেন, ‘এখন আর আগের মতো বিক্রি হয় না। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে দাম বেশি; এর ফলে মানুষ পোশাক কম কিনছে। তবে বিক্রি মন্দের ভালো বলা যায়। গত দুই উৎসবের চেয়ে একটু ভালো বিক্রি হচ্ছে।’
নিউ মার্কেটের বাঙ্গালি বাবুর এডমিন রানা দেব নাথ বলেন, বাঙ্গালি বাবুর শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে এবারের আয়োজন বিশাল। আমাদের হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, আমাদের নিজস্ব ডিজাইন এবং আমাদের ফুল টিমকে নিয়ে জেন্টসদের জন্য আয়োজন করছি। এখন প্রায় এক হাজারেরও বেশি প্রোডাকশন হয়েছে যা এসময় অন্যান্যবারের দ্বিগুণ। ক্রেতাদেরও তেমন সাড়া পাচ্ছি। এবার আমরা ২০% ছাড় দিচ্ছি। পছন্দ না হলে পরিবর্তনের সুযোগ দিচ্ছি। অন্যান্য ব্রান্ডের চেয়ে আমাদের কাছে ক্রেতার চাপ বেশি থাকার কারণ ২০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। বাঙ্গালি বাবু চট্টগ্রামবাসীর জন্য প্রসিদ্ধ ব্রান্ড। বর্তমান জেন্টসদের নিয়ে একমুখী আয়োজন করলেও লেডিস পোশাক নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা আছে বলে জানান, এই ব্যবসায়ী।
নিউমার্কেটর ডিম্যান্ডের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এস এম জাকের আলম বলেন, পূজোকে কেন্দ্র করে যে কালেকশনগুলো করেছি, পুরো মার্কেটের অনান্য ব্রান্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কারো সাথে মিলবে না। বিশেষ করে ক্যাজুয়েল লং সিøভস। ফরমাল কিছু কালেকশন এনেছি যা সম্পূর্ণ ইউনিক। যা আমাদের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে তৈরি। পূজো উপলক্ষে ৩০% ছাড় দিচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান।
এদিকে চকবাজার মতি টাওয়ার, মিমি সুপার মার্কেট, সানমার ওশান সিটি, কেয়ারি ইলিশিয়ামের বেশিরভাগ শাড়ি দোকানদার ক্রেতাদের সময় দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের পূজার বাজারে নারীদের শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজের চাহিদা বেশি। কাতান, জর্জেট, সিল্ক ও এমব্রয়ডারি দিয়ে কাজ করা শাড়ির প্রতি আগ্রহ বেশি ক্রেতাদের। কদর রয়েছে টাঙ্গাইলের তাঁত ও জামদানি শাড়িরও।
নিউমার্কেট ও সানমার ওশান সিটিতে ইমিটেশনের গয়নার দোকানগুলোতেও চলছে ধুম বিক্রি। নারীরা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে কিনছেন চুড়ি, গলার হার, আংটিসহ নানা রকম অলঙ্কার। পোশাকের পাশাপাশি মেয়েদের জুয়েলারি, সিঁদুরসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ বেশ ভালোই বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন দোকানিরা।
পূজা সামনে রেখে ডিজিটাল বাজারগুলোও সরব হয়েছে। অনলাইনে চলছে নানা পোশাকের প্রচারণা, সঙ্গে বিক্রিও বেশ ভালো বলে জানান ব্যবসায়ীরা। অনেকে অনলাইনে ও অফলাইন দু’ভাবেই বিক্রি করছে। কোনো কোনো পেজ দিচ্ছে কাস্টমাইজড সুবিধা।