সুপ্রভাত ডেস্ক »
মা-বাবা কর্মস্থলে। চার বোন ছিল বাসায়। হঠাৎ বাসায় আগুন ধরে যায়। সবার ছোট আড়াই বছর বয়সী বোনটির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তার শরীরের ওপর ‘মানবঢাল’ তৈরি করেন বড় তিন বোন। আগুনে দগ্ধ তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু তিন সপ্তাহের মধ্যে একে একে তিন বোনই মারা যায়। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে ছোট বোনের প্রাণরক্ষার এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা ছুঁয়ে গেছে পাড়া-প্রতিবেশিসহ সবাইকে।
গত ২০ জুন চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার বান্ডেল রোডের সেবক কলোনিতে হৃদয়বিদারক এ ঘটনা ঘটেছে। সেই কলোনিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শতাধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মীর বসবাস। হরিজন সম্প্রদায়ের এ মানুষগুলোকে ‘সেবক’ নাম দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
সেবক কলোনির ছোট্ট দুই কক্ষে র বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন মিঠুন দাশ। তিনি এবং তার স্ত্রী আরতি দাশও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাদের চার মেয়ে, সারথী রাণী দাশ (১৭), সাখশী রাণী দাশ (১৩), হ্যাপি রাণী দাশ (৬) ও আড়াই বছর বয়সী সুইটি রাণী দাশ।
মিঠুন দাশের বড় ভাই চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী অনিকেষ দাশ জানান, সারথী পাথরঘাটা মেনকা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি, সাখশী মিউনিসিপ্যাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি এবং হ্যাপি স্থানীয় সানরাইজ গ্রামার স্কুলের কেজি শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাখশী রাণী দাশ গত ২৪ জুন মারা যায়। সারথী গত ৩০ জুন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। সর্বশেষ বুধবার (১২ জুলাই) হ্যাপি রাণীর মৃত্যু হয়েছে একই ইনস্টিটিউটে। খবর সারাবাংলা।
২০ জুন অগ্নিকা-ের ঘটনায় কোতোয়ালি থানা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল। তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামসুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, দগ্ধ ও স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অগ্নিকা-ের কারণসহ সার্বিক চিত্র উদঘাটন করেন।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করেছি। ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। মা-বাবা ভোরে সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মা বড় বোনদের বলে গিয়েছিলেন, ছোট মেয়ে সুইটির ঘুম ভাঙলে তাকে যেন দুধ গরম করে দেওয়া হয়। মেজো বোন সাখশী সকালে গ্যাসের চুলায় দুধ গরম করে ছোট বোনকে খাওয়াতে খাওয়াতে তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েন।’
শামসুল ইসলাম বলেন, ‘দুধের পাতিল চুলা থেকে নামিয়ে রাখলেও চুলার সুইচ বন্ধ করার কথা মনে ছিল সাখশীর। ঘণ্টাখানেক পর সারথী ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ছোট বোনের জন্য দুধ গরম করতে যান। তিনি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। তখন সুইটিকে বাঁচাতে তিন বোন তার শরীরের ওপর উপুড় হয়ে থাকেন। বাসার চালের সঙ্গে ছিল তাপ প্রতিরোধক রেক্সিন। আগুনে সেগুলো গলে গলে পড়তে থাকে তাদের শরীরের ওপর। চিৎকারের শব্দ শুনে স্থানীয় লোকজন গিয়ে দরজা ভেঙ্গে তাদের চারজনকে উদ্ধার করেন।’
চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে এসআই শামসুল আরও জানান, সারথী, সাখশী ও হ্যাপির শরীরের ৯০ থেকে ৯৭ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। তবে সুইটি অক্ষত ছিল, শুধু কানের কাছে সামান্য আঘাত পায়।
অনিকেষ দাশ বলেন, ‘আমিও ভোরে কাজে বের হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ঘরে শুধু ছেলে ছিল। শুনেছি, গ্যাসের চুলা জ্বালানোর পরই ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। চার মেয়েই ঘরের ভেতর আটকে ছিল। আমার ছেলে গিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলে। আশপাশের লোকজন মিলে আগুন নেভায়। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়নি। খবর পেয়ে আমরা এসে চার মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তিন জনের এক জনকেও বাঁচাতে পারলাম না।’
বুধবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন হ্যাপি রাণীকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মেয়ের লাশ নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরছেন মিঠুন দাশ ও তার স্ত্রী আরতি দাশ। তিন মেয়ে হারানো এ দম্পতি কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
শোকস্তব্ধ পুরো সেবক কলোনি। হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষগুলো যারা সবসময় মাতিয়ে রাখেন নিজেদের কলোনিকে, আজ সেখানে সুনসান নীরবতা। শোকে বাকরুদ্ধ স্বজনরা।
দুপুরে সেবক কলোনিতে গিয়ে দেখেন, মিঠুন দাশের বাসার সামনে জড়ো হয়ে আছেন প্রতিবেশিরা। কেউ মানতে পারছেন না একে একে তিনটি মেয়ের মৃত্যু, চোখের সামনে হেসেখেলে বড় হয়েছে যারা। তাদের মামা উত্তম লাল দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে একসঙ্গে তাদের হারাব কখনও ভাবিনি। ঈশ্বর এত নির্মম হতে পারে!’
চসিকের স্থানীয় আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলেন, ‘দগ্ধ তিন জনের অবস্থা শুরু থেকেই গুরুতর ছিল। এক বোনের মৃত্যুর পর বাকি দু’জনকে আমি ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নিই। আমি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তাদের ঢাকায় পাঠাই। সিটি করপোরেশন থেকে ১০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় সাংসদ শিক্ষ া উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাহেব ৫০ হাজার টাকা সহযোগিতা করেছেন। এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের এলাকায় ঘটেছে, মনকে কোনোভাবেই মানাতে পারছি না!’