চোখ দুটো উঠে জলে ভরিয়া

অরূপ পালিত »

আবেলের ডাক্তারী পড়া শেষ, এখন ইন্টার্ন চলছে। বন্ধুর সংখ্যা কম। সবাই বান্ধবী ওর, তাও বিদেশিনী। অনেকের ধারণা, একটি ছেলে আর একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলে তা প্রেমের সম্পর্কে পরিণত হয়। মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আধুনিকতার যুগে সবকিছু হাতের মুঠোয়। দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদার মানসিকতা সম্পন্ন ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব লেখাপড়াকে এগিয়ে নিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখাপড়া নিয়ে মেয়ে বান্ধবীরা মেয়েদের হিংসা করে। কিন্তু ছেলেরা তা করে না। তাই অনেক মেয়ে মনে করে মেয়েদের ক্ষেত্রে ছেলেবন্ধুই ভালো।
নির্মল প্রকৃতির মতো শৈশব-কৈশোর কেটেছে তার। বাংলাদেশের মেডিকেলে বিদেশিদের পড়তে আসা একেবারে কম নয়। তার মধ্যে ইন্ডিয়ান একজন হচ্ছে টিনা। নেপালের সাত-আটজন ছেলেমেয়ে ওরা ওদের মতো করে চলে। ভিন্ন একজন আছে ভুটানের। সে সৌন্দর্য আর রুপচর্চা নিয়েই থাকতে পছন্দ করে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আবেল আর টিনার মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন অপূর্ণ। আবেল ছেলেদের সাথে মিশে না বলে তাকে সব বন্ধুরা আবুল বলে ডাকে। অথচ আবেল নামটির অর্থ কী সুন্দরÑ শ^াস বা নিশ^াস। ইন্টার্ন শেষ এখন। যে যার দেশে চলে যাবার পালা। টিনা অনেক আগে থেকে বলছে একবার আবেলকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। টিনার বাড়ি শিলিগুড়িতে।
পড়ার চাপে দেশের বাইরে বেড়ায়নি কখনোই আবেল। টিনারও ইচ্ছে যাবার সময় আবেলকে এবার শিলিগুড়ি নিয়ে যাবে। ঘুরে আসা হলো আর ওর মা-বাবার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেয়া হলো। আবেল টিনার মুখ থেকে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, সিকিমের ছাঙ্গু লেক, নাথুলার নিউ এবং ওল্ড বাবার মন্দির, নাথাং ভ্যালির কথা শুনতে শুনতে কেমন জানি মনের মধ্যে ওদিকে যাবার তৃষ্ণাও জাগে। টিনা ভারতের শিলিগুড়ির বাসিন্দা হলে কি হবে সিকিমে যাওয়া হয়নি কোনো সময়। টিনা আবেলসহ ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়।
আবেলকে পেয়ে টিনার পরিবারও বেশ খুশি। আবেলের সাথে টিনাকে সিকিমে (গ্যাংটক) একা পাঠাতে পরিবারের কেমন যেন সংকোচবোধ হচ্ছে। বন্ধু হলেও আবেল বাংলাদেশি তার ওপর দ্জুনই তরুণ। আবেল বুঝতে পারে টিনার মার মুখের ভাষা। সবাইকে একসাথে নিয়ে গ্যাংটকে যাবার জন্য বলে। ইন্ডিয়ান মেয়েরা আবার বেশ চটপটে। টিনা আবেলকে নিয়ে সবার জন্য ছয় আসনের একটি জিপ ভাড়া করে।
সকালবেলা শিলিগুড়ি থেকে সবাই রওনা দিল সিকিমের উদ্দেশে। মনে অনেক আনন্দ নিয়ে জিপের সামনের সিটে বসল আবেল। মোট পাঁচজনের মধ্যে আবেল একমাত্র পুরুষ গার্ডিয়ান। টিনার ভাইটি ছোট, খুব আদুরে। পেছন থেকে আবেলের কাঁধে হাত দিয়ে আছে। আবেল যেন ওর কাছে অনেক দিনের চেনা। ইন্ডিয়ার সোমো টাটাগুলি বাংলাদেশের বড়লোকের বিএমডাব্লিউ। ড্রাইভারের পাশে আবেল বসে আছে। ড্রাইভারকে আবেল বলে, কতক্ষণ সময় লাগতে পারে। ড্রাইভার হাতের আঙুল দেখিয়ে চার ঘণ্টা লাগবে বলে ইশারা করে। সবুজ পাহড়ের মাঝদিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে। ধোঁয়াটে, সবুজ প্রকৃতি তাকে বিস্মিত করে। ড্রাইভারেরও রুচি আছে বটে। গাড়ির সামনে বেশ কয়েকটা রজনীগন্ধার স্টিক রেখেছে।
সবাই যখন প্রকৃতির প্রেমে ডুবে গেছে কে যেন পেছন থেকে আবেলের গালে জোরে থাপ্পড় মারে। আবেল স্তব্ধ হয়ে পড়ে। জন্মের পর এটাই কোনো নারীর প্রথম স্পর্শ। আবেল পেছন ফিরে তাকায়। মেঘের আচরণ দেখে বুঝতে পারে ঝড় আসছে। হঠাৎ টিনার এমন আচরণে ওর মা ওর দিকে ছানাবড়া চোখ নিয়ে চেয়ে আছেন। বোন আর ছোটভাইটা খিলখিল করে হাসছে।
-মা, ও ঘুমাচ্ছে আর একটা মশা ওর মুখের ওপর বসেছে, দেখ! ওর খবর নেই। তাই মশা তাড়ালাম।
ছোটভাইটা বমি আসছে বলাতে টিনা সুযোগ নিয়ে ছোটভাইকে সামনের সিটে বসিয়ে দিল। আবেলকে মহারানি পাশের সিটে এনে বসাল। সবুজের খেলা শুরু শিলিগুড়ি থেকে। আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুইপাশে সেগুনবন। পাখির মনমাতানো শব্দ। এতো সুন্দর জায়গা দেখে আবেলের মনে হলো, সবার দরকার একটু-্আধটু দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়া। টিনার এলোমেলো চুল বারেবারে আবেলের চোখ ঢেকে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে নায়িকাকে নিয়ে আবেল উড়ছে। যেভাবে কৃষ্ণচূড়ার ওপর মৌমাছি উড়ে বেড়ায়।
সাথে যোগ হলো মিষ্টি গানÑ
কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া।
সোনার বরণী মেয়ে,
বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দু’টি উঠে জলে ভরিয়া ॥
তারপরের গানÑ
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
আবেলের মনে হলো একটিবার উঠে দাঁড়ায়। সবাইকে ওর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, এটি রবীন্দ্রসংগীত হলেও আমাদের জাতীয় সংগীত।

মনে হল, একঝাঁক সারস উড়ে গেল। সবুজ অরণ্যানীর মাঝে হারিয়ে গেছে সে। ওর উড়ো চুলগুলোর জন্য আবেল বাইরে দৃষ্টি ফেলতে পারছে না। আবেগে-আবেশে উন্মাদ হয়ে মনে হল মহারানি এসব ইচ্ছে করেই করছে। চুল সরানো চেষ্টায় আরেকটা থাপ্পড় গালে। আবেল হতবাক। মহারানি কোনো বিষয়ে রেগে আছেন? টিনার মা দুজনের অবস্থা বুঝে চোখ বন্ধ করে আছেন।
-আবেল টিনার কানের কাছে বললো, কি হয়েছে? তুমি তো কোনো সময় এ রকম আচরণ করোনি।
টিনা চোখ রাঙিয়ে কানে-কানে বলল, চুপ কর, গলা টিপে দেবো। এখনি নামো, আমার খিদে পেয়েছে।
ড্রাইভার গাড়ি থামালো রাংপো চেকপোস্টে এসে। টিনা হাতব্যাগ থেকে আবেলের ছবি আর পাসপোর্টের জেরক্স কপি (ফটোকপি) সহ ড্রাইভারকে দিয়ে দোতালায় পাঠায়ে দিলো। বিশাল এক ঐতিহ্যবাহী ফটক। রঙবেরঙের নকশাকাটা কারুকার্যে সিকিমের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। সিকিম প্রবেশে সবার জন্য পারমিশন লাগে। পাসপোর্টধারী একমাত্র আবেল। আর সবাই ইন্ডিয়ান। তাদের আধার কার্ড আছে। ভারতীয়দের জন্য মনে হল ১০ টাকা দিয়ে পারমিট। আর বিদেশিদের জন্য (আবেলের জন্য) ২০০ রুপি। এখান থেকে পারমিট না নিলে নাকি গ্যাংটকের কোনো হোটেলে থাকা এবং বেড়ানো যাবে না। ড্রাইভার টিনার পরিচিত হওয়ায় বেশ ভালো হলো। আন্তরিকতার সাথে সবকিছু ওই করে দিচ্ছে।
অনেক নাটকে ভরা সারা রাস্তা। বিকেল ৫টার দিকে সবাইকে নিয়ে পোঁছায় এমজি মার্গ, গ্যাংটকে। গ্যাংটক হচ্ছে সিকিমের রাজধানী। টিনার মুখে শোনা যায়, সকালের সূর্যের আলো বরফে পড়ার দৃশ্য দেখতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২-১৩ বার এই জায়গায় এসেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টি থাকাতে বরফে প্রতিফলিত অনন্য শোভার সৃষ্টি দেখতে পারার দুঃখটা রয়ে গেল। সন্ধ্যা নামতেই তামমাএা কমে আসছে। আবেল শীতের কাপড় আনেনি। এখানে সবসময় ঠান্ডা অনুভূত হয়। আজ মনে হচ্ছে তাপমাত্রা ১০ এর নিচে।
আবেল হোটেল বুক করলো। আবেলের থেকে যখন হোটেল মালিক আধার কার্ড চেয়েছেন আবেল পাসপোর্ট বের করে দেন। তখন হোটেলের জিএম আবেলকে বলেন, ভাই আপনি তো আমার দেশি। এই হোটেলের মালিকও বাংলাদেশের সাতকানিয়ার লোক। কথায় বলে না ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে? রাত ৮টার মধ্যে এখানকার সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি খেয়ে হোটেলে ফিরতে বলেন। ধুমপান, যেখানে-সেখানে থুথু ফেলাÑ এসব বিষয়ে বেশ কিছু রেস্ট্রিকশন আছে। হোটেলের ম্যানেজার তার পরের দিন সকাল বেলা নাথুলার বাবা মন্দিরের জন্য গাড়ি বুক দিয়ে দিলেন।
টিনা জেনেও বলেনি এখানের আবহাওয়া ঠান্ডা। সবাই শীতের পোশাক এনেছে। হোটেলের ম্যানেজার আবেলের জন্য ওয়াইন পাঠিয়ে দিয়েছেন। একপেগ খেয়ে আবেল হোটেল থেকে বার হলো। প্রাকৃতিক রূপের পাহাড়ের শহরকে রাতের আলোয় দীপাবলির মতো লাগছে। পাহাড়ের খাপে-খাপে বাড়িগুলোর লাইটিংয়ের আলোয় মনে হচ্ছে জোনাকি পোকা পিদিম জ্বালিয়ে গাছে বসে আছে।
সিকিম শহরে বাংলাদেশের মুদির দোকানের মতো মদের দোকান। এখানের সবাই বনে মদ আর (চামিং) নুডুলস খেতে ব্যস্ত। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে দেখে ফেরার পথে আবেল হোটেলে মদ নিয়ে আসে। মদের গন্ধ পেয়ে আবেলের রুমে মহারানি হাজির। আবেল তাড়াতাড়ি গালে হাত দিয়ে রাখলো। মনে হচ্ছে, এইবার আর আবেলের রক্ষে নেই। টিনা আবেলের বাধ্য ছেলের মতো আচরণ দেখে হেসে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমি কি খারাপ? ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারেনি, এতটুকু।
টিনার মার্জিত আচরণ আবেলের মনের বরফ গলছে। এমন আদরের উষ্ণতা কেনোদিন পায়নি সে। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওরা দুজন বিবাহিত।
আবেল টিনার একটু ছোঁয়া পেতেই সবকিছু ভুলে যায়।
ছাড়ো না বলেই সেই থাপ্পড়!
সেই ভোরে ওঠে বরফের ওপর সকালের লাল সূর্য দেখার জন্য আবেল দাঁড়ায়। রঙধনুর অপরূপ সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গ্যাংটক শহরে আসা ধন্য হয়ে যায়। পেছন থেকে এসে চাদর দিয়ে টিনা জড়িয়ে ধরলো।
-তুমি ঘুমাওনি
-না।
-তুমি
-না।
-ছাড়ো সবাই আসতে পারে।
-না আসার জন্য সবাইকে বাইরের থেকে দরজা লক করে দিয়ে রেখেছি।
এক চিলতে উষ্ণতার স্পর্শে আবেলের মুখে অনেক প্রাপ্তির হাসি।
-এতোটুকু পাবো টিনা আমি কোনোদিন ভাবিনি। জানি না আজকে কোন জন্মের পুুণ্যের ফল ভোগ করছি।
আবেলের ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল কোনো রাজকুমারী নিয়ে গল্প করে রাত কাটানোর। মিষ্টি বাতাসে মাথার পাশে বসে চুলে বিনি কাটবে। কফি না হয় চায়ের চুমুক দিয়ে বলবে, আরেকটু হবে গো। সে আদরে জড়িয়ে রাখবে। বাস্তবে পূরণ হলো আজ।
-এমন সুখ কয়জনের ভাগ্যে হয় বল?

নাথুলা বাবার মন্দিরে যাবার জন্য সকাল ৭টা দিকে হোটেলের সামনে (মহিন্দ্র ্েকারপিও) জীপ এসে দাঁড়ায়। প্রায় ১৪ হাজার ফিট উপরে উঠতে হবে।
বাবা মন্দিরের উদ্দেশ্য গাড়ি চলতে শুরু করলো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, ড্রাইভার বললেন পেছনে ফিরে না থাকাতে। এখানে অক্সিজেন কম। শ্বাসকষ্ট থাকলে বলবেন।
আবেলের হাত কে যেন ভয়ে আঁকরে ধরলো।
পাহাড়ের খাদের কিনার হতে চূড়া পর্যন্ত ছোট ছোট বাড়ি। সবুজ অরণ্য। কুয়াশাঢাকা মেঘরানি আর প্রকৃতি যেন সবার মাথার ওপর হাত বুলাচ্ছে।
আবেল মনে মনে চিন্তা করে এইখানে কবি-শিল্পীদেও আসা ভালো। নিজে কবি হলে হয়তো দু-একটা কবিতা লেখা যেতো। গানের গলা খারাপ বলে গাইতেও পারছি না। টিনার গানের গলা সুন্দর কিন্তু বলার সাহস নেইÑ একটি গান করো।
সবাই এসে একটা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে গেল। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা উপভোগ করছে সবাই। কেউ-কেউ কফি নয়তো চায়ের চুমুকে নিজেদেরকে প্রকৃতির সাথে বিলিয়ে দিয়েছে। ছোট মার্কেটে কাপড় আর চায়ের দোকান। এবার রানি যেন আবেলকে একা পেতে মরিয়া। একপাশ হয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুখ ফিরিয়ে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ যাচ্ছিল সাদা বরফের দিকে। মেঘ আর কুয়াশা যেন মহারানিকে বুকে নিয়ে আলিঙ্গন করছে। বড্ড হিংসে হলো মেঘের জন্য। কী করে যে আলিঙ্গন করছে ওকে!
হ, মেঘরাজ তুমি ভাগ্যবান। এই দস্যিমেয়ের থাপ্পড়থেকে বেঁচে গেলে।
আবেল টিনার কাঁধে হাত রাখতেই টিনা আহত বুনোহাঁসের মতো আবেলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মনে হলো একপশলা বৃষ্টি হয়েছে।
-কি হল টিনা ! সবাই মোমো বা কফি খাচ্ছে, তুমি খাবে না?
-আমি তোমাকে একা চেয়েছি। আমার অনেক কথা বলার ছিল। নিমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে এলে আমার গুষ্টিসুদ্ধ।
নাথুলায় বেশ শীত। টিনা শীতে কাঁপছে। টিনার মান ভাঙানো তো দুর্গ-পাহাড় সমান।
টিনাকে কিছু বললো না আবেল, কারণ গালে জায়গা নেই আর।
চল খেতে যাওয়া যাক।
টিনার চোখ যেন জবাফুল, এত বোকা কেমনে হয়?
কিছু সময় পেরিয়ে গেলো। গাড়ি তো চলছে। মনের গাড়ি কোন সময় হতে হায়েনার দলের মতো ঝাপটে ধরলো, আবেল বুঝল না।
কুয়াশার চাদর ও মেঘ পথের কাঁটা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরপর লাল পাথরের পাহাড়। আঁকাবাঁকা পথ। হরেক রকমের কাপড়ের ফ্ল্যাগ বতাসে উড়ছে। অপূর্ব দৃশ্য। দুজনই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সবাই পুরাতন বাবা মন্দিরে যাচ্ছে।
কিছুদূরে দেখা যাচ্ছে চীনা আর্মি সীমান্ত প্রহরায় ব্যস্ত। চাঙ্গু লেকটা বরফে ঢাকা।
সবাই আনন্দে দিশেহারা। গাড়ি থেকে নামতে সবার মাঝে প্রচণ্ড শীত অনুভূত হলো। বরফে ঢাকা সারা গ্যাংটক শহর। বরফ হাতে নিয়ে সবাই খেলা করছে। টিনা হাত ধরে আছে আবেলের। ওর বিশ্বাস, বাবা মন্দিরে দুজন একসাথে গেলে ওর মানসকর্ম পূর্ণ হবে। ভারতীয় সৈন্যরা বাবাকে ‘নাথুলার বীর’ মনে করেন।
মানুষের কিছু বিশ্বাস মনে সুখ আনে।
টিনা যে বদলে গেছে টিনার মায়ের চোখ এড়ায়নি।
ওদের দুজনকে মন্দিরের এক সাথে ঢুকতে দেখে ওর মা ছোট ভাইবোনকে নিয়ে ইয়াকের (তিব্বতের গরু) পিঠে চড়তে চলে যান।
আবেল টিনাকে বলে, রুপোয়তে উঠবে? তোমার ভালো লাগবে। টিনা খুশি মনে রুপোয়তে উঠে যায়। চাঙ্গু লেকের ওপর বরফে ঢাকা রুপোয়ের ওপর থেকে দেখে আবেলকে শক্ত করে ধরে রাখে। আবেলের চোখ দুটো আবেগে জলে ভরে উঠেছে।
ইন্ডিয়ান নওজোয়ানরা দর্শনার্থীদের গাড়ি নিয়ে ফিরে যেতে বললেন। সবাই গাড়িতে বসে আনন্দ করছে। এমন সুন্দর মুহূর্ত শুধু স্মৃতিতে বন্দি হয়ে থেকে যাবে আবেলের মনে। যার বাস্তব কোনো রূপ দেওয়া যাবে না।
টিনাকে শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। আর দু’টা দিন বাকি। সাহস করে টিনাকে এখনি বলা হয়নি ‘তোমাকে ভালোবাসি’। আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে থাকবে তুমি সারাজীবন। তোমার ভালোবাসা আর আবেগের স্মৃতিগুলো আমাকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে কামড়াবে। আমাদের অনেক বছর একসাথে পথচলা। হয়তো আমি যাবার পরে তুমি ফ্রাসট্রেশনে ভুগবে। একজীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না। আমি যেটুকু তোমার কাছ থেকে পেলাম, তৃপ্তি নিয়ে ফিরতে পারবো। তোমার দেশে কেউ জাতধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু! আমার দেশ বাংলাদেশ। তবে! ফিরে আসবো তোমার ভালোবাসার কাছে।