সুপ্রভাত ডেস্ক »
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সর্বব্যাপী প্রভাব পড়বে। কৃষির সেচ খরচ থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সবকিছুতেই দেখা দেবে ঊর্ধ্বগতি, শেষ পর্যন্ত যার চাপ পড়বে ভোক্তাদের ওপরই।
নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে মানুষের পকেটে টান পড়েই আছে, তার ওপরই যোগ হলো কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও অ-খাদ্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে মুদ্রাস্ফীতির একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে। কারণ এই মূল্যবৃদ্ধি যাত্রীদের ভ্রমণ খরচ এবং পণ্য পরিবহন খরচ বাড়াবে। সড়ক ও নৌপথ উভয় পরিবহন মালিকরা ইতোমধ্যেই ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। শেষপর্যন্ত এসব চাপের বোঝা পড়বে ভোক্তাদের ওপর।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যানের ভাড়ায়। লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে। আর এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বহু খাতে।
ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাক-সবজি থেকে শুরু করে যে সব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সবেরই দাম বাড়বে।
ফলে দেশের সব পরিবারেরই মাসিক খরচের হিসাব নতুন করে সাজাতে হবে।
দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পেও যে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পড়বে, সেটাও বলছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে সেচ পাম্প ও পাওয়ার টিলার ডিজেলে চলে বলে কৃষকেরও ব্যয় বাড়বে। মাছ ধরা ট্রলারগুলোরও জ্বালানি ডিজেল, তাই সেখানেও খরচা বাড়বে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘বেআইনিভাবে’ সরকারের এই ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণায় ভোক্তার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন তিনি।
গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে লোকসান কমাতে সরকার বৃহস্পতিবার থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে।
একবারে এত মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। সব সেক্টর থেকেও এই মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ আসছে।
ক্যাব চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির গণশুনানি করে এই মূল্য বৃদ্ধি করার কথা। বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ‘বেআইনি’।
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের প্রেক্ষাপটে হোক কিংবা অন্য যে কোনোভাবেই হোক, জ্বালানি তেলের বার বার হ্রাস-বৃদ্ধি করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যুক্তিসঙ্গত নয়।
“স্থিতিশীল রাখার জন্য জ্বালানির ‘মূল্য স্থিতিশীলতা তহবিল’ গঠন করা উচিৎ। যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল, তখন বিপিসি হাজার হাজার কোটি টাকা তেল বিক্রি করে আয় করেছে। তারা সেই টাকা কী করেছে? তাদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ।”
শুরুর বিশৃঙ্খলা পরিবহনে
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে বিভিন্ন স্থানে বাস থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয়ভাবে শুক্রবার থেকে বাস-ট্রাক চালানো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবহন মালিকরা।
এক লাফে তেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানোয় বাসের ভাড়া না বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তবে মহামারীর এই সময়ে যাত্রীরা এই বর্ধিত ভাড়া দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান তারা।
ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলে পরিবহন মালিকরা ইতোমধ্যে শুক্রবার সকাল থেকে বাস-ট্রাক না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিআরটিএ রোববার বৈঠক ডেকেছে। আপাতত তখন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন ও গণপরিবহন বন্ধই থাকছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আমদানি পণ্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় এবং রপ্তানি পণ্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় পরিবহন করা হয়।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ায় ৪০০ কিলোমিটার পথে জ্বালানিবাবদ খরচ দুই হাজার টাকা বেড়ে যাবে। এভাবে অন্যান্য দূরত্বেও বর্ধিত খরচ হিসাব করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে।
খরচা বাড়ছে নৌপথেও
লঞ্চ মালিকরা ধারণা করছেন, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে হাতিয়া ও সমপরিমাণ দূরত্বের গন্তব্যে নতুন করে ৬০ হাজার টাকা এবং বরিশাল ও সমপরিমাণ দূরত্বে অন্তত এক লাখ টাকা করে বেশি খরচ পড়বে।
এছাড়া ঢাকার সদরঘাট থেকে চট্টগ্রামের সদরঘাট ও দেশের বিভিন্ন আন্তঃজেলায় চলাচল করে কয়েকশ মালবাহী লাইটার জাহাজ, বালুবাহী বাল্কহেড ও অন্যান্য ছোট যাত্রীবাহী জাহাজ।
এছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সাগরতীরবর্তী জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন যেসব ছোট-বড় নৌযান নদী-সমুদ্রে গমন করে তাদের সবাই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে ডিজেল। ফলে ডিজেল জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে প্রতিটি মানুষের জীবন ও জীবিকা।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান জানান, সমুদ্রগামী একটি ২০০ টনের জাহাজ ২২ দিনের সাগলে গেলে ৬৭ লাখ টাকার ডিজেল প্রয়োজন হয়। জ্বলানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে নতুন করে ১৫ লাখ টাকার খরচ বাড়বে।
মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ২৬২টি মাছ ধরার জাহাজ সমুদ্রে গমন করে। কিন্তু এসব জাহাজে ধরা পড়া মাছ কেনার জন্য রয়েছেন ১৫ থেকে ২০ জন ক্রেতার একটি ‘সিন্ডিকেট’। সামুদ্রিক মাছের বিনিময় মূল্য প্রতিকেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে জাহাজ মালিকদের লাভ থাকে খুবই কম।
নুরুল কাইয়ুম বলেন, “জাহাজ মালিকদের মাঝে মধ্যেই মাছ ধরতে গিয়ে লোকসান গুনতে হয়। এখন তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে খরচের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে লোকসানের মুখে থাকা অনেক ব্যবসায়ীকে এই খাত থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।”
একই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ আবিদ হোসেন জানান, সমুদ্রগামী মাছ ধরার জাহাজের সার্বিক খরচের ৭০ শতাংশই হয় তেলের মূল্য বাবদ। ফলে জ্বালানির ২৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে একেকটি জাহাজকে ১৫ লাখ থেকে ১৮ লাখ টাকা বেশি গুনতে হবে। কারণ সাগরে একমাস অবস্থান করার জন্য জাহাজগুলোকে ৮০ টন জেল জ্বালাতে হয়।
অন্য খাতেও প্রভাব
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি পণ্য পরিবহনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে, যা সামলে উঠা এই খাতের পক্ষে সম্ভব হবে না।
“এমনিতেই আমাদের দেশে এখন ৭/৮ হাজার টাকার কভার্ডভ্যান ভাড়া বেড়ে ১০/১২ হাজার টাকা, আবার ক্ষেত্র বিশেষ ১৫/২০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। এখন নতুন করে দাম বৃদ্ধির খরচ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা চিন্তাও করা যাচ্ছে না।”
এছাড়া পোশাক কারখানার জেনারেটর ও বয়লারগুলোও ডিজেলে চলে বলে সেখানেও ব্যয় বাড়বে বলে জানান তিনি।
সরকারি পর্যায়ে পাইকারি বিদ্যুতের একক ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিপিডিবির একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডিজেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে ১২০০/১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে সেজন্য অতিরিক্ত ৭০০ কোটি টাকা বেশি খরচ করতে হবে পিডিবিকে। কারণ, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি খরচ বাড়লে কমলে সেটা মূল ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ‘পাস থ্রো’ হয়ে যায়। অর্থাৎ দাম যতটা বাড়ে সেটা বিদ্যুতের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
ডিজেলের সঙ্গে কেরোসিনের দামও লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রামের গৃহস্থালিতে কিংবা দোকানে যারা কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করেন, তাদের ব্যয় বাড়বে।
বিপিসির হিসাবে, গত এক দশক ধরে কৃষিখাত, শিল্পখাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত, যোগাযোগ খাত, গৃহস্থালি খাতে দেশে প্রতি বছর ৫০ লাখ থেকে ৭০ লাখ টন ডিজেল ও কেরোসিন ব্যবহার হচ্ছে।
কেবল ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে যোগাযোগ খাতে ৬৪ শতাংশ, কৃষিখাতে ১৮ শতাংশ, শিল্পখাতে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, গৃহস্থালি খাতে ২ শতাংশ জ্বালানি ব্যয় হয়েছিল।
সূত্র : বিডিনিউজ ও টিবিএস