এম. রেজাউল করিম চৌধুরী »
চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সদা চঞ্চল কর্ণফুলী চট্টগ্রামকে দুই অংশে বিভক্ত করেছে। এর একদিকে রয়েছে বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আর অন্যদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা। চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশের সাথে মহানগর, উত্তর ও দেশের অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগের যে মাধ্যম ছিল তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলটি সেই অপর্যাপ্তটা অনেকটাই ঘোচাতে পারবে। একসময় কালুরঘাট রেল সেতুকেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে একমাত্র সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হত। এরপর চাক্তাই-শিকলবাহা অংশে স্টিলের স্পেনের ওপর বসানো কাঠের সেতু দিয়ে হাল্কা ও মাঝারি যানবাহন দুপারে পারাপার করত। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ওই অংশে কাঠের সেতুর পরিবর্তে কংক্রিটের তৈরি শাহ আমানত-কর্ণফুলি ৩য় সেতু উদ্বোধন করলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। হালকা, মাঝারী ও ভারী যে কোন ধরনের যানবাহন এখন এই সেতু দিয়ে সহজে পারাপার হতে পারে বলে, বিগত দশকে পশ্চিম পটিয়া ও কর্ণফুলী এলাকায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মাধ্যমে রূপান্তরের সোনালী গল্প রচিত হয়েছে। ওয়ান সিটি টু টাউনের পথে হাটছে ঐশ^র্যের চট্টগ্রাম, যে স্বপ্ন নিয়ে চট্টলার অবিসংবাদিত নেতা, সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাকে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। নানা জটিলতায় এটি থমকে গেলে, চট্টগ্রামের আরেক অবিসংবাদিত নেতা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপি পটিয়া উপজেলার অধীনে থাকা কর্ণফুলী তীরবর্তী ইউনিয়নকে নিয়ে পৃথক উপজেলা গঠন করে দ্রুত উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দূরদর্শী এ জননেতার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য সন্তান আলহাজ¦ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ওই এলাকার সাংসদ নির্বাচিত হন এবং পর্যায়ক্রমে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টির কারণে কর্ণফুলি তীরবর্তী ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে কর্ণফুলী উপজেলা গঠিত হয়। আধুনিক নগরের সাজে সাজতে থাকে উপজেলা কর্ণফুলী। পাশাপাশি সারা দেশে ১০০টি বিশেষ শিল্প এলাকা গঠন করার ঘোষনার প্রেক্ষিতে আনোয়ারায় গড়ে উঠছে চায়না ইকোনোমিক জোন, কর্ণফুলী ও আনোয়ারার অংশে গড়ে উঠেছে কোরিয়ান ইপিজেড। এক ঘন্টার কাজ সারার জন্য জোয়ারভাটা হিসেব করে দু’দিনের সময় নিয়ে যে বাঁশখালীর মানুষদের এক সময় চট্টগ্রাম শহরে আসতে হত, তারাই এখন কাজের জন্য সকালে শহরে এসে সারাদিনের কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারে। তাছাড়া স্বয়ং বাঁশখালীতে লেগেছে শিল্পায়নে ছোঁয়া-গড়ে ওঠেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এগ্রো ফার্মসহ ছোট ছোট কারখানা। উত্তরের জেলাগুলোর যানবাহনকে দক্ষিন চট্টগ্রামসহ পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবান ও টেকনাফে যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের ওপর অনেক ঘুরতি পথে শাহ আমানত সেতু হয়েই যেতে হয়।
আগামী ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান টানেল’টি উদ্বোধনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ঐশ^র্য ও সমৃদ্ধির মুকুটে নতুন স্বর্ণময় পালক গুঁজে দিতে চট্টগ্রাম আসছেন উন্নয়নের বিস্ময়মানবী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। এ টানেল দিয়ে নদী পার হয়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুলে দেবেন আরেকটি স্বপ্নদুয়ার। সাংহাইয়ের আদলে কর্ণফুলীর দু’পাড়ে দ্রুত গড়ে উঠবে ওয়ান সিটি টু টাউন। কমে আসবে পার্বত্য বান্দরবান, কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিনের সাথে চট্টগ্রামের উত্তরের জেলাগুলোর দূরত্ব, বাঁচবে জ¦ালানী খরচ ও শ্রমঘন্টা। দেশের পর্যটন শিল্পে পড়বে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব, আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এশিয়ান হাইওয়ের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে আনবে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন।
বঙ্গবন্ধু টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী টানেলপথ পাড়ি দিয়ে আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠে জনসভায় যোগ দিবেন এবং জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। আজ মনে পড়ছে সেই জনসভার কথা। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির ময়দানে জনসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা ঘোষণা দিয়েছিলেন; তিনি যদি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান, তবে চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিজ হাতেই করবেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। চট্টগ্রামকে তিনি রূপান্তরিত স্বপ্নের চট্টগ্রামের পথে নিয়ে গেছেন, দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত এক বাংলাদেশকে বিশ^ দরবারে হাজির করেছেন। বিশ^ বাংলাদেশকে জানত একটি ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ প্রাকৃতিক বৈরীর দেশ, ঝড়, খরা, বন্যা, মঙ্গা ও দারিদ্রপীড়িত হাহাকারের দেশ হিসেবে। শেখ হাসিনা তার দুরদর্শী নেতৃত্ব ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে বিশ^ দরবারে তুলে ধরেছেন। বিশ্বসভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন অত্যন্ত সম্মানের আসন তৈরি করে নিয়েছেন, দেশকে দিয়েছেন উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। জিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে উন্নত, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মহাসড়কে আছি এখন আমরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে আবারও যদি আমরা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আনতে পারি তবে অচিরেই বাংলাদেশ বিশে^র উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাতারে পৌঁছে যাবে-এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, মেয়র চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।