ঘেউ…

আজাদ বুলবুল :

সবাই খাচ্ছে পেটপুরে। আগেভাগে কিনে-টিনে হেঁসেলভর্তি যাদের তারাও পাচ্ছে ত্রাণের নামে বস্তাভর্তি শুকনো খাবার। মাপ পাচ্ছে কারেন্টসহ অন্যান্য বিলের বিলম্ব ফি। বাড়িওলার কাছে দাবি তুলছে গত মাসের ঘরভাড়া না নেয়ার। ভাড়াঘরের আয়ে যাদের সংসার চলে তারা কিভাবে পরিবার চালাবে, সেটা না হয় পরেও ভাবা যাবে। সবাই ভাবছে সবার কথা আর আমরা থেকে গেলাম অপাংক্তেয়। করোনাকালে এই বৈষম্য অগণতান্ত্রিক!

নাহ! নেই। ভালোমন্দ যাই হোক, শুকনো হোক, ভেজা হোক নেই মানে  নেইই। নানা জায়গায় নানাভাবে খোঁজাখুঁজি চলেছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। নগরে এখন গরম নেমেছে। শীত, কুয়াশা বা ঝড়বাদল নামবে না সেটা নিশ্চিত। আশ্রয়ের জন্য যেমন-তেমন ব্যবস্থা হলেই হলো। কিন্তু খাবার ছাড়া চলবে কি করে? অনুসারীদের অসন্তোষ চরমে। যা দরকার তার সংস্থান করতে না পারলে, আমাদের চাহিদা মেটাতে না পারলে আপনাকে নেতা হতে কে বলেছে? অনেক ধৈর্য ধরেছি। আর নাহ্!

আরেকজন রাগত কণ্ঠে গলা উঁচিয়ে বলে, আমাদের এ অবস্থা কেন? দূরদর্শী চিন্তা না করে সবাইকে এই আপদে কেন ফেললেন? জবাব চাই।

নেতা নিরুত্তর। অনুসারীদের প্রশ্নবাণে এখন আর ক্ষেপে ওঠেন না। তাদের জিজ্ঞাসার যুতসই জবাব দিতে গিয়ে কূটতর্কে জড়ান না বরং দিশেহারা নাবিকের মতো অভিযোগ, অনুযোগ, কটুবাক্য, বদবুলি নীরবে হজম করছেন। ঘাড় নত করে পুচকে অনুচরের রাগত ক্ষোভ আর হুল  ফোটানো সমালোচনা বিরস বদনে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। হাতি  যেমন খেদায় পড়লে চামচিকাও ল্যাং মারতে আসে নেতার আজ তেমন দুর্দিন। লিডারগিরি যাই-যাই করছে। কর্মীদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে না পারলে নেতৃত্ব থাকে কী করে?

সার্সন রোডের গোয়াছি বাগান এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনুসারী বাড়তে থাকে নেতার। মেডিকেল হোস্টেলের পিছনকার বিরাটকায় পাহাড়, সন্নিহিত মহাসড়ক, উপগলি-তস্যগলি তার কন্ট্রোলে। চকবাজার, গুলজার মোড়, প্যারেড কর্নার, দেবপাহাড়, কলেজ রোড ধরে মিসকিন শাহ মাজার পেরিয়ে গনি বেকারি পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য। বারো-চৌদ্দজনের একটি বহর নিয়ে সদর্প চলাফেরা তার। কাজীর দেউড়ির ভোমা গ্রুপ আর কাপাসগোলার কাউলা গ্রুপের সাথে সমঝোতা থাকার কারণে বিরোধে জড়াতে হয়নি কখনো। আসকারদিঘি পাড়ে গজিয়ে ওঠা পাঁচজনের একটা পেতিনিদল নানা উস্কানি দিয়ে ভোমা গ্রুপের সাথে ঝগড়া লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু পেতেনির ফাঁদে পা  দেয়নি নেতা। এমনিতেই সুখশান্তির কমতি নেই। উটকো ঝামেলা বাধিয়ে কী লাভ! চকবাজারের এগারোটা রেস্টুরেন্ট, পাঁচলাইশের তিনটা কমিউনিটি সেন্টার আর দেবপাহাড়ের মতো অভিজাত পাড়া যার কব্জায় তার তো রাজকপাল। কিন্তু সেই কপালে এমনিতর রাহুর দশা নামবে তা ভাবতেই পারেনি দলনেতা বাঘা। প্রথম প্রথম ঘটনাটি আঁচ করতে পারেনি কেউ। বলাবলি হচ্ছিল, ইটালি, জার্মানি, কাতার, কুয়েত থেকে অসুখ নিয়ে দেশে ঢুকেছে অজস্র রোগী। এসব লোকেদের পরিবার থেকে আলাদা রাখা হবে। শুনে তারা খুশিই হয়েছিল। অসুখবিসুখ হলে এখানে মেজবানি দেয়ার ঘটনা বাড়ে। দাওয়াতি-বেদাওয়াতিদের কপাল খোলে। মেজবানি মানে তিন-চারদিন ধরে অঢেল গোশত- শুরুয়া, নলার ঝোলসহ মুখরোচক খানাদানা।  সেটা না হয় বাদই গেলো। শহর জুড়ে শুরু হয়েছে সিটি করপোরেশন ইলেকশনের তোড়জোড়। মোড়ে মোড়ে ঝুলছে পোস্টার। বাতাসে উড়ছে টাকা। এখানে-ওখানে লুটছে খানাখাদ্যের মচ্ছব। লোকজনের হাতও উদার। সুতরাং চিন্তা কী! ভয়জাগানিয়া আশংকা তুড়ি মেরে  নৈশবিহারে নামতে দেরি হয় না তাদের। এক মুরুব্বি বলেছিল, যৎকালে তদবিচার। ঘটনা যখন ঘটবে তখন দেখা যাবে। এখন দুশ্চিন্তা করে ঘুম হারাম করা নেহাত বোকামি।

তবু ঘুমহারাম হয়ে গেছে বাঘা নেতার। নগর জনপদ কোলাহলশূন্য। বাপদাদার মুখে শুনেছিল হরতালের গল্প। স্বৈরাচারী সরকারকে হটাতে নাগরিকরা দোকানপাট, লোকচলাচল বন্ধ রাখতো। যানবাহন চলাচল বন্ধ করতো। তাতে আহার-বিহারের তেমন অসুবিধা হতো না কারোই। কিন্তু এ কোন ধরনের ধর্মঘট! সরকারি নির্দেশ গৃহবন্দি লোকজন। বন্ধ  হোটেল-রেস্তোরাঁ। বন্ধ বিয়ে, মেজবান, শ্রাদ্ধ, মুখেভাত। ওরস নাই,  মেলা নাই। সভা, মিছিল-মিটিং কোনোটাই নাই। কোন এক অজানা  রোগের ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে আছে আপন ঠিকানায়।

সবাই কি আর সিঁটিয়ে থাকে? করপোরেশনের সেবকেরা এখন মহাদায়িত্ববান হয়ে উঠেছে। বাসাবাড়ি থেকে ফেলা এঁটোখাবার, বাসি তরকারি, চিবুনো হাড়, মাছের কাঁটা কিছুই জমতে পারছে না ডাস্টবিনে। এখানে পড়তে না পড়তে ছোঁ মেরে তুলে রাখছে করপোরেশনের ঢাকনা দেয়া ট্রাকে। ছিটানো হচ্ছে ব্লিচিং মেশানো পানি। পরিচ্ছন্ন আর বিশুদ্ধনগর উপহার দিতে একপায়ে খাড়া তারা। ওদিকে গরিবদের খাবার সহায়তা দিতে তৎপর তরুণ ভায়েরা। ত্রাণের জন্য আগে লাইন ধরতে হতো মানুষকে। এখন সাহায্যদাতারা চাল ডাল  তেল নুন আলু সাবানের ব্যাগ পৌঁছে দিচ্ছে দুয়ারে। টেলিভিশন বক্তৃতায় মন্ত্রিরা বলছেন, দেশে প্রচুর খাবার রয়েছে। খাদ্যসংকট ঘটবার   কোনো আশংকা নাই। আপনারা বাসা বাড়িতেই থাকুন। নিজের স্বাস্থ্য নিরাপদ রাখুন, খাদ্য সংস্থানের চিন্তা রাষ্ট্রের। অথচ দলের লোকেদের খাবার যোগাড় করতে পারছে না বলে বাঘানেতার মসনদ আজ টলায়মান।

ভোমা এসেছিল কালরাতে কাউলাকে সাথে নিয়ে। কাজির দেউড়ির অভিজাত গ্রীবা ফোলানো নাদুস ভোমা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। কাউলার গলা ভেঙে কুঁই কুঁই অবস্থা। গলা যে তার ঝগড়াঝাটি করে ভাঙেনি, এটা বিলক্ষণ বুঝতে পারে বাঘা। ওদের অবস্থা যে তারচে খারাপ এটা বুঝতে পেরেও তৃপ্তির ঢেকুর জাগে না। ঢেকুর আসবে  কোত্থেকে? পেটে খাবার থাকলে তো!

রোদ পড়ছে আকাশ ফাটিয়ে। কারা নাকি বলেছে, জোর গরম পড়লে করোনা ভাইরাস মরে যাবে। সবাই চায় রোদ বাড়ুক, গরম পড়ুক। কিন্তু  রোদ বাড়লে তিষ্ঠানো দায়। মুখ গলিয়ে বেরুতে চায় আধহাত জিহ্বা। এই চৈতালি গরমে হাঁপাতে হাঁপাতে হোস্টেল গেট গলিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের ছায়াবহুল প্রাঙ্গণে জমায়েত হয় তারা। জনশূন্য ক্যাম্পাসে  কেবল পাতাঝরার খসখসে আওয়াজ। নির্জন শেরে বাংলা হোস্টেলের ধুলোমলিন চত্বরে গোল হয়ে বসে। ধূলিওড়া প্যারেড মাঠে ঝলসে পড়ছে তপ্ত রোদ্দুর। রসিক হাজারী রোডের ফ্ল্যাটগুলো থেকে ঝরে পড়ছে নিঃসঙ্গতার রাগিণী। আফসোস আর হাপিত্যেসভরা ক্ষোভ উছলে ওঠে জটলা থেকে।

প্রশাসন ত্রাণ দিচ্ছে, আমরা পাচ্ছি না।

পুলিশও দিচ্ছে, আমাদের হিসেবে নিচ্ছে না।

সরকারি নেতারাও দিচ্ছে। দুস্থ কর্মীরাই পাচ্ছে না, আমরা  কোন ছার!

হতাশ গলায় নেতা বলে-

পরিবেশ বিজ্ঞানী নিশ্চুপ। পাখি বাঁচাও সংসদের অবস্থা তথৈবচ। বন্যপ্রাণী রক্ষা কমিটি তো মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। লকডাউন দেখে কী খুশি তারা! ডলফিন ভিড় জমায় উপকূলে, হাঙর লাফালাফি করে  মোহনায়, লালকাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি বাড়ে  সৈকতে। সাগরলতায় ফুল  ফোটে। আহ! কতো কিছু দেখে তারা! কিন্তু কাকের যে গলাবাজি থেমে  গেছে, ওড়াউড়ি কমে গেছে, তা কি দেখে কেউ?

অনুসারী, অনুচর, ভক্তকূলের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে বাঘানেতা আহ্বান জানায়-

আর চুপ করে থাকা নয়। নির্বিবাদে সকল অনিয়ম মেনে নেয়া নয়। আসুন, আমরা একযোগে গর্জে উঠি। সমস্বরে দাবি জানাই। উচ্চকণ্ঠ আওয়াজ তুলে বলি-

আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের খাবার দাও।

ঘেউউউউউউ…..

সবার সম্মিলিত খাদ্য প্রার্থনার আহ্বান একটি প্রলম্বিত  ঘেওওওওউউউউউউ ধ্বনি হয়ে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আওয়াজ আন্দরকিল¬া, সদরঘাট, নিউমুরিং ছুঁয়ে পতেঙ্গা সৈকতের বেলাভূমিতে ঘুরতে থাকে। তারপর বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের দোলায় নাচতে নাচতে মহাচীনের উহানের পথে রওনা দেয়।