সুপ্রভাত ডেস্ক »
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকটে রয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালের মেঝেতে রোগীদের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে, বেশিরভাগ সময় কোনও চেতনানাশক ছাড়াই। মঙ্গলবার একটি হাসপাতালে ভয়াবহ হামলায় আহত বেসামরিকদের জীবন বাঁচাতে তারা এমন বেপরোয়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ ও অবরোধ জারি থাকায় এমনিতেই গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি ছিল। হামলায় বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হওয়ায় পরিস্থিতি একেবারে নাজুক হয়ে পড়ে।
হামলার জন্য ইসরায়েলের বিমান হামলাকে দায়ী করেছে গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাস। ইসরায়েল দাবি করেছে, ইসলামিক জিহাদ নামের অপর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর ব্যর্থ রকেট উৎক্ষেপণ দায়ী। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, হামলায় অন্তত ৫০০ মানুষ নিহত হয়েছেন।
হাসপাতালে হামলার ভয়াবহতা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলে অবতরণ করেছেন যুদ্ধ থামানোর আশায়। ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে হামলার পর এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
তেল আবিবে অবতরণের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সমর্থন করেছেন বাইডেন। তিনি বলেছেন, হাসপাতালে বিস্ফোরণের দায় মনে হচ্ছে ইসরায়েলের নয়। আমি যা দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে অপরপক্ষঘটিয়েছে, আপনারা নন।
বাইডেনের অবতরণের কিছুক্ষণ পর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট ছুড়েছে ফিলিস্তিনিরা। বুধবার দক্ষিণ গাজাসহ বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলি বোমা বর্ষণ অব্যাহত ছিল। যদিও ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের জন্য দক্ষিণ গাজাকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে বলে আসছিল তারা।
হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর বাইডেনের সঙ্গে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠক বাতিল হয়েছে। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, আগে জর্ডান যাওয়ার কথা থাকলেও এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু ইসরায়েল সফর করবেন।
জর্ডানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে।
বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনের ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ব্যাখ্যা করে বলেছে কেন গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণে তারা দায়ী নয়। মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, তাদের বাহিনী আল-আহলি হাসপাতাল এলাকায় বোমা বর্ষণ করছিল না। ইসরায়েলি রাডার নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের ছোড়া রকেট হাসপাতালে বিস্ফোরণের সময় কাছের একটি কবরস্থানে পতিত হয়েছে। স্বাধীন ভিডিওতে দেখা গেছে আকাশ থেকে এক ঝাঁক রকেট নামছে।
তিনি আরও বলেছেন, রকেটটি হাসপাতালের পার্কিং এলাকায় আঘাত হেনেছে। বিমান হামলা হলে সেখানে গর্ত থাকত।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত নিহতের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। তারা আরও বলেছে, গাজা থেকে গত কয়েক দিনে ৪৫০ টি রকেট ইসরায়েলে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার হাসপাতালের হামলাকে হামাস ‘একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ’ হিসেবে উল্লেখ করে দাবি করেছে, ইসরায়েলি হামলায় এই বিস্ফোরণ হয়েছে। ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলের দাবি অস্বীকার করে বলেছে, দেশটি চেষ্টা করছে নিজেদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে।
গোষ্ঠীটি উল্লেখ করেছে, আল-আহলি হাসপাতাল খালি করতে ইসরায়েল নির্দেশ দিয়েছিল। এর আগেও হাসপাতালটি ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা ও বোমা যেভাবে পতিত হয়েছে এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তৃতি ইসরায়েলের দিকে ইঙ্গিত দেয়।
বিস্ফোরণে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শত শত ফিলিস্তিনি আল-আহলিসহ বিভিন্ন হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা আশা করছিলেন যে, হাসপাতাল অন্তত ইসরায়েলি বোমা বর্ষণ থেকে নিরাপদ থাকবে। এর আগে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েল।
আল-আহলি হাসপাতালে কর্মরত প্লাস্টিক সার্জন গাসান আবু সিত্তা বলেছেন, তিনি একটি বিকট বিস্ফোরণ শুনেছেন এবং তার অপারেশন কক্ষের ছাদ ধসে পড়ে।
ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, আহতরা আমাদের দিকে হুমড়ি খেয়ে আসতে লাগল। আমি কয়েক শ’ নিহত ও গুরুতর আহতকে দেখেছি। পা উড়ে যাওয়া এক ব্যক্তির ঊরু আমি বেঁধেছি। এরপর ঘাড়ে আঘাত পাওয়া আরেকজনের চিকিৎসা করতে চলে যাই। খবর বাংলাট্রিবিউন।
বার্তা সংস্থা এপির যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, হাসপাতালের মেঝেতে ছিন্নভিন্ন শরীর। অনেকেই তরুণ। এ সময় আগুন জ্বলছিল। কম্বল, স্কুলব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বুধবার সকালে বিস্ফোরণস্থলটি পোড়া গাড়িতে ছেয়ে গেছে এবং মেঝে কালো হয়ে গেছে।
হাসপাতালে পরিচালক সুহাইলিয়া তারাজি বলেছেন, বিস্ফোরণের পর পরিস্থিতি এমন ছিল যে যা কেউ দেখেনি বা কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের হাসপাতাল ভালোবাসা ও পুনর্মিলনের একটি স্থান। এই যুদ্ধে আমরা সবাই পরাজিত। এটি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।
বিস্ফোরণের পর শহরের প্রধান হাসপাতাল আল-শিফাতে প্রায় ৩৫০ জন আহতকে নিয়ে আসতে থাকে অ্যাম্বুলেন্স ও প্রাইভেটকার। হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সেলমিয়া বলেছেন, এমনিতেই হাসপাতালটিতে সক্ষমতার চেয়ে রোগীর সংখ্যা ছিল বেশি। নতুন আহতরা আসায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। চিকিৎসকরা বাধ্য হন মেঝেতে অস্ত্রোপচার করতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও চেতনানাশক ছিল না।
আবু সেলমিয়া বলেছেন, আমাদের সরঞ্জাম প্রয়োজন, আমাদের ওষুধ প্রয়োজন, আমাদের বেড প্রয়োজন, আমাদের চেতনানাশক প্রয়োজন, আমাদের সবকিছু প্রয়োজন।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গাজা উপত্যকায় সরবরাহ প্রবেশের অনুমতি না দিলে সর্বাত্মক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন গাজা উপত্যকায় জরুরি ত্রাণ সরবরাহ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে তখন এই নৃশংস হামলা হলো। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলি সর্বাত্মক অবরোধের মুখে রয়েছে ছিটমহলটি। হাজার হাজার মানুষ খাবার ও পানির খোঁজ করছেন হন্য হয়ে।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে গাজার ২৩ লাখ মানুষের জন্য ত্রাণ সরবরাহের একটি সমঝোতার বিষয়ে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। তবে বুধবার সকাল পর্যন্ত কোনও ত্রাণ রাফাহ ক্রসিং অতিক্রম করেনি। এই ক্রসিং মিসরের সঙ্গে গাজার একমাত্র সংযোগ। মিসরে কয়েক শ’ ট্রাক ত্রাণ নিয়ে গাজায় প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত কয়েক দিনের হামলায় গাজায় অন্তত ৩ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি। ধারণা করা হচ্ছে গাজার বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা রয়েছে অন্তত আরও ১হাজার ২০০ জন। তারা জীবিত বা মৃত হতে পারেন।
হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০। হামলার সময় হামাস যোদ্ধারা প্রায় ২০০জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে গেছে। ইসরায়েলি হামলার জবাবে প্রতিদিন রকেট ছুড়ছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকামীরা।