সুপ্রভাত ডেস্ক »
গত এগারো বছর ধরে একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী যে তার প্রিয় ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই, এটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই বহুকাল ধরেই। কিন্তু দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ যে আচমকা প্রকাশ্যে চলে আসবে এবং দলের ভেতরে রীতিমতো ঝড় তুলে দেবে – তা একরকম অকল্পনীয় ছিল মাত্র কদিন আগেও।
ঠিক সেই অভাবিত ঘটনাই এখন ঘটছে – মমতা ও অভিষেকের দূরত্ব ও বিরোধের খবর নিয়ে এখন শুধু কলকাতা নয়, ভারতের জাতীয় মিডিয়াও রীতিমতো সরগরম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দূরত্ব যে তৈরি হয়েছে এটা তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও কেউ অস্বীকার করছেন না। অথবা বলা ভালো, করতে পারছেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাসভবন কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে এক চালার টিনের বাড়ি, আজও সেখান থেকেই তিনি নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালান। অন্যদিকে আধুনিক প্রজন্মের রাজনীতিবিদ ও ডায়মন্ড হারবার আসনের এমপি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কার্যালয় কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিটে শান্তিনিকেতন নামে এক আধুনিক বিল্ডিংয়ে।
তাই মমতা ও অভিষেকের এই মতান্তরকে রাজনৈতিক মহলে অনেকে ‘কালীঘাট বনাম ক্যামাক স্ট্রিট’ লড়াই বলেও বর্ণনা করছেন। কিন্তু এই ‘লড়াই’ শুরু হলো কীভাবে? তৃণমূলে এর পরিণতিই বা কী হতে পারে
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বাংলা ট্রিবিউন কথা বলেছে তৃণমূলের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রথম সারির নেতার সঙ্গে। তাদের অনেকে সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, অনেকে আবার ঘোষিতভাবেই দলের ‘যুবরাজ’ অভিষেকের শিবিরের লোক। দুপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যে ছবিটা উঠে আসছে তা এক কথায় অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং!
কালীঘাটের এক নিম্নবিত্ত যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বিয়ে-সংসার করেননি, কিন্তু পুরো পরিবারে এক ভাইয়ের ছেলে অভিষেকই যে তার সবচেয়ে প্রিয়, তা কখনও গোপন ছিল না। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে অভিষেকই ছিল সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, রাজনীতিবিদ পিশির স্নেহছায়া সব সময় তাকে ঘিরে থাকতো, তৃণমূল নেতারা সবাই তা জানেন।
এমনকী বছর পঁচিশেক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দেশের রেলমন্ত্রী আর অভিষেক নেহাতই স্কুলছাত্র , তখন একদিন ঘরোয়া আড্ডায় কথাচ্ছলে এই প্রতিবেদককেও তিনি বলেছিলেন, ‘জানেন, আমার এই ভাইপোটা পড়াশুনোয় এতো ভালো আর বুদ্ধিমান যে কী বলব। সিপিআইএম সরকার (রাজ্যে তখন তারাই ক্ষমতায়) বদমায়েশি না-করলে ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ারও ক্ষমতা রাখে।’
এরপর অভিষেক ধীরে ধীরে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন এবং পিশির ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনীতিতেও পা রেখেছেন। ২০১৪ সালে কলকাতার কাছে ডায়মন্ড হারবার আসন থেকে প্রথমবারের মতো জিতে এসে তিনি পার্লামেন্টে পা রাখেন। এমপি হিসেবে প্রথম টার্মে অভিষেক অবশ্য খুবই ‘লো প্রোফাইল’ বজায় রাখতেন এবং মিডিয়াতে কোনও কথাও বলতে চাইতেন না – কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিবারের সদস্যকে রাজনীতিতে প্রমোট করে ‘স্বজনপোষণে’ উৎসাহ দিচ্ছেন, সেই অভিযোগও তখন থেকেই উঠতে শুরু করে।
এই পটভূমিতেই বছরকয়েক আগে বিবিসি হিন্দি বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (যখন তাকে কথিত স্বজনপোষণ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ভারতের অন্য পলিটিক্যাল ফ্যামিলিগুলোর দিকে তাকান একবার – ওরা সবাই পাঁচজন/ ছজন করে (প্রমোট) করছে – আর আমি মাত্র একজনের জন্য কিছু করতে পারবো না?’
সেই একজন – বলাই বাহুল্য – আর কেউ নন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলের একাধিক নেতা জানাচ্ছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও এহেন প্রিয় ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যে বিরোধের মূল কারণ হলো দল কীভাবে পরিচালিত হবে, সেই পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য।
সাবেক কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতিবিদ মমতা মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতে জানেন, আমজনতার সঙ্গে তার ‘কানেক্ট’ করার ক্ষমতা অসাধারণ। বছরের পর বছর এই ফর্মুলাই তাকে রাজনীতিতে সাফল্য দিয়েছে, জুগিয়েছে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস।
অন্যদিকে এমবিএ ডিগ্রিধারী অভিষেক তরুণ প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত রাজনীতিবিদ, তিনি দলের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আর ডিসিপ্লিন নিয়ে আসার পক্ষপাতী। তিনি চান দল পরিচালিত হবে পুরোপুরি কর্পোরেট কায়দায়, যেখানে শেয়ারহোল্ডারদের মতোই দলের অনুগামী-সমর্থকদের প্রতি তৃণমূলের একটা দায়বদ্ধতা থাকবে।
তৃণমূলের একজন রাজ্যসভা এমপি-র ভাষায়, ‘ঠিক এই ধারণা থেকেই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বড় ধাক্কা খেয়ে অভিষেক নিজের উদ্যোগে প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেন, যাতে তারা তৃণমূলকে আবার জয়ের রাস্তায় নিয়ে আসতে পারে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনই প্রমাণ করে দিয়েছে সেই সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল।’
ওই এমপি যথারীতি অভিষেকের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু মমতা-শিবিরের একজন বর্ষীয়ান নেতা আবার বলছেন, ‘মনে রাখতে হবে গত বছরের ভোটে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে মমতাই আমাদের জিতিয়েছেন, প্রশান্ত কিশোর নন। আর আমরা ভোটে জেতার পর আইপ্যাক যেভাবে শুধু অভিষেককেই তুলে ধরতে চাইছে সেটাও দলের জন্য কোনও ভালো সংকেত দিচ্ছে না।’
দুই শিবিরেই যাতায়াত আছে, রাজ্যের এমন একজন মন্ত্রী আবার বলছেন, ‘বিরোধটা আসলে ব্যক্তিগত ইগো নিয়ে নয়, দল পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে। একটা উদাহরণ দেই… অভিষেক যেমন চান বিভিন্ন নির্বাচনে দলের প্রার্থী বাছাই হোক সার্ভে করে, মানুষের মধ্যে জনমত জরিপ চালিয়ে। অন্যদিকে মমতাদি বিশ্বাস করেন রাজনীতি ওভাবে হয় না, দলের শতভাগ অনুগত সৈনিককেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নিতে হয় তার জেতার ক্ষমতা বুঝে!’
পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের যে অন্তর্বিরোধ সামনে এসেছে, তার মূলেও আছে ঠিক এই কারণটাই।
তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গোয়া বা ত্রিপুরাতে পায়ের তলায় রাজনৈতিক জমি পেতে অভিষেকের নেতৃত্বে তৃণমূল যেভাবে ঝাঁপিয়েছে এবং বিপুল লোকবল ও অর্থবল খরচ করছে – সেটাকেও মমতা অনেকটাই পণ্ডশ্রম বলে মনে করছেন।
এছাড়া দলের ভেতর ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতির সমর্থনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে প্রকাশ্যে সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটাও খুব ভালোভাবে দেখছেন না। বিশেষত এই নীতির যিনি প্রধান ব্যতিক্রম – সেই ফিরহাদ হাকিম (একাধারে রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র) দুটো শীর্ষ পদে আছেন মমতার ইচ্ছাতেই, ফলে তার বিরুদ্ধাচারণ করা মানে মমতার সিদ্ধান্তকেই চ্যালেঞ্জ করা।
এই পটভূমিতেই শনিবার রাতের বৈঠকে তৃণমূলের সব ‘সর্বভারতীয়’ পদ অবলুপ্ত করা হয়েছে – ফলে দলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদেও আর অভিষেক থাকছেন না। কিন্তু এর অর্থ কী, নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার থেকেও মমতা প্রিয় ভাইপোকে বঞ্চিত করবেন?
গত সিকি শতাব্দী ধরে তৃণমূলের সঙ্গে জড়িত একজন শীর্ষ নেতার ভাষায়, ‘কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জেনে রাখুন, আজকের তারিখেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবিসংবাদিতভাবে দলের এক থেকে দশ নম্বর। কিন্তু এগারো থেকে বিশ নম্বর জায়গাটা অভিষেকেরই, আর কারুর নয়!’
তবে নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা তৃণমূল দলটা তার অবর্তমানেও যেন পুরনো পরীক্ষিত, সাবেকি ও জনমুখী কায়দাতেই চলে – কর্পোরেট ডিসিপ্লিন আমদানি করার নামে দলটা যেন মানুষের নাগালের বাইরে না চলে যায় – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন ঠিক সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন