কাজী নজরুলের কবিতায় ‘জয় বাংলা’ অতঃপর বাংলাদেশ

মেহেরুন্নেছা মেরী

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেলাম। এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন সর্বপ্রথম দেখেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর অসাধারণ দেশাত্মবোধক গান আর কবিতাসমগ্রের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি তাঁর গানে বলেন :
‘স্বাগত বঙ্গে মুক্তিকাম!
সুপ্ত বঙ্গে জাগুক আবার লুপ্ত স্বাধীন সপ্তগ্রাম!
শোনাও সাগর-জাগর সিন্ধু-ভৈরবী গান ভয়-হরণ,
এ যে রে তন্দ্রা, জেগে ওঠ তোরা,
জেগে ঘুম দেওয়া নয় মরণ!
তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই লুপ্ত স্বাধীন ‘সপ্তগ্রাম’ ঠিকই জেগে উঠেছিল ১৯৭১ সালে। সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় ‘সপ্তগ্রাম’ই স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। দেশ তো পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত হয়েছে, এখন এই দেশ মানে কবি নজরুলের সেই কবিতার সপ্তগ্রামের নাম কি হবে? বঙ্গ মায়ের কোলে জন্ম নেয়া অনেক কবি-সাহিত্যিকই বঙ্গমাতাকে ভালবেসে বঙ্গভূমির অনেক সুন্দর-সুন্দর নাম দিয়েছেন যুগে যুগে। রবি ঠাকুর বলেছিলেন ‘সোনার বাংলা’, জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন ‘রূপসী বাংলা’। কিন্তু যিনি আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমিকে ‘বাংলাদেশ’ বলে প্রথম ডেকেছিলেন তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে নজরুল তাঁর ‘ভাঙার গান’ কাব্যে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় সর্বপ্রথম ‘জয় বাঙলা’ শব্দযুগলও ব্যবহার করেন। নজরুলের কাব্য থেকে কালক্রমে এটি স্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান জনগণকে তাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল।
কবিতাটির কিছু লাইন উদ্বৃতি হিসাবে দেয়া যেতে পারে :
‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!‘
এই কবিতা রচনার এক চমকপ্রদ গল্প আছে। অবিসংবাদিত এই নেতার প্রতি কবির স্বাগতিক উচ্চারণ :
‘স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর, বাংলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’ জননীর আদেশ পেলেই মুক্তিসেনানী হুকুম দেবেন যুদ্ধের এবং সেই ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর ছিন্নমস্তক লুটাবে জননীর পায়ের তলায়।’
কবি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ‘পূর্ণচন্দ্রে’র জেলমুক্তির দিনে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি। এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম ‘জয় বাঙলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সুতরাং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’স্লোগানটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা থেকে গ্রহণ করেছিলেন।
রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ-কাব্যেও ‘স্বাধীনতা’, ‘হুকুম’ ও ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনিগুচ্ছ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। আর এও লক্ষ্য করার বিষয় যে, ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতাটির ২৭ নম্বর পঙক্তির শুরুতেই ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনি বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চারিত : ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ’। ২৮ নম্বর পঙক্তি : ‘জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন ’ এই জোড়া পঙক্তিতে (২৭-২৮) ‘জয়’ ধ্বনিটি ঘূর্ণিছন্দে ৫ বার উচ্চারিত হয়েছে এবং নজরুলের আরেকটি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ গদ্যে (‘বাঙালির বাঙলা’) একই আবহ বারবার প্রযুক্ত হয়েছে। ‘যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র মহাশয়ের পর ভবিষ্যৎ নেতা-সেনানীদের প্রতিও এই আহ্বান সম্প্রসারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহ্যিক ধারারই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত নেতা-সেনানী; আর তাঁর কণ্ঠেই পুনরুচ্চারিত সেই বিজয়-ধ্বনি : ‘জয় বাঙলা’।
এবার ‘বাংলাদেশ’কবিতা প্রসঙ্গে আসি। এই কবিতার শুরুটা এমন :
‘নম নম নমো বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চিরমধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর ॥
শিয়রে গিরিরাজ হিমালয় প্রহরী,
আশিস-মেঘবারি সদা তার পড়ে ঝরি,
যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,
ওড়ে আকাশছেয়ে মেঘ-চিকুর ॥’
বায়ান্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলনে কবি নজরুলের কবিতা ও গান বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছে। তাঁর বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘ওরে ধ্বংসের পথের যাত্রী দল’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু’, ‘চল চল চল’, ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ ইত্যাদি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে, করবে।