খোবাইব হামদান :
সকাল থেকে হিমবায়ু বহমান। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছি। মন-মননে ওঠাার ইচ্ছে শূন্যের কোঠায়। জেগেও যেন জাগতে ইচ্ছে করছে না। বাবা অল্পক্ষণ আগেই জাগিয়ে দিয়ে গেলেন। সকাল সকাল না উঠলে চঁচামেচি উপহার পেতে পারি। আলসেমিকে কোনো মতে চাপা দিয়ে ওঠে বারান্দায় গেলাম। বাড়ির আঙিনায় পানি থৈ থৈ করছে। উঠোন থেকে নিয়ে গ্রামের সব পথঘাট যেন নদীতে পরিণত হয়েছে। পানিগুলোতে আবার ছোট-ছোট ঢেউ, সুনসান নীরবতায় বাতাসের মৃদু সুর ও বৃষ্টির ঝনঝন ছন্দ মনের কোণে ভালোলাগার আবেশ গড়ে।
বাবার বাড়ি থাকাকালে স্কুল ফাঁকি দেয়া অসম্ভব। বাবা বলেন, ‘শিক্ষার্থীর একমাত্র আলয় শিক্ষালয়।’ সকাল থেকে লাগাতার বৃষ্টি হওয়ার দরুন আপুর কথায় স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে পড়তে বললেন বাবা। হলরুমে টিভি দেখার উদ্দেশ্যে হালকা ঢুঁ মারতে যেই যাব যাব তখনই চেঁচানো শুরু। পড়ার জন্য সারাদিন মাস্টার মশাইকে সামনে থাকতে হবে না কি? এত পাহারাদারি করে পড়াতে হবে কেন? নিজে নিজে কি একটুও পড়া যায় না? নাকি স্কুলে না-যাওয়া মানে একেবারে পড়ালেখা বন্ধ? বাড়িতে পড়া যাবে কি যাবে না সে আমি জানি না। আমি যে আজ পড়বো না এটা আমার মনের কথা।
কিছুক্ষণ পরেই আব্বুকে কল দিলেন হেডস্যার। জানালেন, আজ আমাদের স্কুলে পাঠাতে হবে না। আরও একটা মজার খবর জানালেন, উনি আজ আমাদের পড়াতে বাসায় আসবেন না। শুনতেই আনন্দে আত্মহারা। মনের মাঝে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতা থৈ থৈ…! বছরের এসহ দুয়েকটা দিন হয়তো সচারাচর বন্ধ ব্যতীত স্কুলে যাওয়া হয়নি। বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিদ্যালয়ে যাওয়া আবশ্যকীয়। আর আমার স্যার ইনি তো শুক্রবার জাতীয় বন্ধ, সেটাও ভুলে যান। কিন্তু আজ স্যার আসতে পারবেন না বৃষ্টির কারণে নয়, উনার ব্যক্তিগত কাজে।
না চাইলেও পড়ার রুমে আমাকে বসতে হলো। আপুর সাথে পড়ার রুমে চলে এলাম। তখন মনে পড়লো স্যারের দেয়া গল্পের বইটির কথা। সেটা স্কুল লাইব্রেরির বই, স্কুল হতে গল্পছড়ার বই যারা পড়তে নিতে চায়, তাদের দেয়া হয়। পড়া শেষ করে ফেরত দিয়ে দেয়। একটা বইয়ের জন্য সর্বোচ্চ দুসপ্তাহ সময় নেয়া যায়। স্যার কয়েকদিন আগে আমাকে ডেকে বইটি দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে পড়তে লাগলাম আমি। মিনা-রাজুর গল্পের বই। সেখানে দেখলাম বৃষ্টির দিনে মিনা, রাজু এবং ওদের বন্ধুরা মিলে বৃষ্টির দিনে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাচ্ছে এবং উল্লাস করছে। হিংসায় বুক জ্বালাতন করে, কেন আমি মিনার সাথে রাজুর জায়গায় থাকতে পারলাম না!
গল্পটি পড়লাম কয়েকবার, তারপর আপুকে শোনাতে লাগলাম। আপু আমার হাত থেকে বইটি নিয়ে পড়তে লাগলো। হঠাৎ আপু আমায় চমকে দিয়ে বললো, চল্ আমরাও কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ছাড়ি।
ভালো কাজে দেরি করতে নেই! পুরাতন ক্যালেন্ডার নিয়ে উপস্থিত আমি। বললাম চলো, নৌকা বানানো শুরু করি। আপুও নেমে এলো মেঝেতে। দুজনই ছটপট নৌকা বানাতে লাগলাম। সব ক্যালেন্ডার দিয়ে আমরা বড়-ছোট এগারোটি নৌকা বানালাম। এমন মজাদার মূহূর্তে ভাজা চিঁড়া নিয়ে প্রবেশ করলেন মা। কী? পড়ার খবর না রেখে এসব চলছে, হ্যাঁ! একটা মিষ্টি হাসি হেসে দুটি নৌকা, যেগুলো আমি মনগড়া বানিয়েছি তা খুলে মা আবার সুন্দর করে বানিয়ে দিলেন। ভাজা চিঁড়া মুখে নিতে নিতে অপেক্ষা করছি বৃষ্টি কখন থামবে। ভাবতেই আনন্দ পা, বাড়ির আঙিনাজুড়ে যে মহাসমুদ্র তৈরি হয়েছে সেখানে আমাদের বানানো নৌকাগুলো ভাসবে। বৃষ্টর থামাথামি নাই। আমাদের দমাদমি নাই। ক্ষণিক মিনা-রাজু’র গল্পের বই নিয়ে দেখি ওরা কেমন করে ভাসিয়েছিল ওদের নৌকা। চিন্তা করি আমরা কেমন করে ভাসাতে পারি আমাদের নৌকা। মনে ভিন্ন রকমের এক উত্তেজনা। মা চলে গেলে দুজনই মুখে হাত দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে গল্প করছি। বিশেষ করে আজ নৌকার গল্প হচ্ছে। কত রকম নৌকা আছে? পাশের জেলে বাড়ির জেলেদের নৌকা নিয়ে বিভিন্ন কথা। স্টিমার কি, লঞ্চ কি? কোনটা নদীতে থাকে, কোনটা সমুদ্রে, এইসব…! কোথায় কোথায় নৌকা, জাহাজ, সমুদ্র এসব নিয়ে গল্প পড়েছি, সেগুলো কি? রবিনসন ক্রুসো ও ট্রেজার আইল্যান্ডের ‘জিম হকিন্স’-এর গল্পও কিছু কিছু বলে আপু।
কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্ট থেমে গেলে দুজনই কাগজের নৌকা নিয়ে দিলাম ভোঁ দৌড়। উঠানের পাশে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যেন মনে হচ্ছে আমি সমুদ্রের তীরে দঁড়িয়ে থাকা মান্যগণ্য একজন মহান নাবিক। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার সহকারী। সমুদ্রের ওপর ভাসবে এখন আমাদের এগারোটি নৌকা। বড় নৌকাগুলো একপাশে রেখে প্রথমে ছোট নৌকাগুলো ছাড়তে লাগলাম পানিতে। একে-একে সব নৌকা পানিতে ছেড়ে দিলাম। সেগুলো ভাসতে লাগলো ঠিক মিনা-রাজুর নৌকার মতো। নৌকার ওপর আমি তো বসে নেই, ভেসে যাচ্ছে আমার উল্লসিত হৃদয়।