সুভাষ দে »
করোনার কাল যেটি গত বছরের মার্চ থেকে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে তা ক্রমে অতিমারির রূপ নিয়েছে এবং এখনো প্রতিদিন প্রাণসংহার করে চলেছে। বলা হচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এখন, কোনো কোনো দেশে এটি দুর্বল হয়েছে, ধরণও পাল্টিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি পরিবর্তিত রূপে অনেক ছাপ রেখে যায়, এর বিষক্রিয়া মানুষের শরীরে আরো দীর্ঘদিন থেকে যাবে, যেমন অন্যান্য কিছু রোগ এখনো আমাদের ভোগায় ফ্লু, কালাজ্বর, ডেঙ্গু, কলেরা যদিও এগুলির প্রতিরোধে এখন টিকা, প্রতিষেধক ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। এসব রোগ এখনো আমাদের ভোগায়।
আমার এই নিবন্ধের মূল বিষয় কোভিড-১৯ আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যে বিষাদ সময় আমাদের দারিদ্র্য, দুঃখ, বেদনা, হতাশা, সমাজ বিচ্ছিন্নতা, অসহায়ত্ব ও নৈরাশ্যের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে সে বিষয়ে কিছু আলোচনা তুলে ধরা।
করোনা মানসিক বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে এক বড়ো জনগোষ্ঠীকে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে, দরিদ্র পরিবারের অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েছে। পঠন-পাঠন, সহপাঠীদের সাহচর্য, খেলাধুলা, বিনোদন এসব থেকে বঞ্চিত হওয়ায় কিশোর-তরুণদের মধ্যে নানা ধরণের নেতিবাচক প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। কিশোর-তরুণদের কিছু অংশ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ, ক্রিমিন্যাল কাজে জড়িয়ে পড়েছে। সেই সাথে আছে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান না থাকা, চাকরিচ্যুতি, পেশা থেকে বিযুক্তি, ব্যক্তি ও তার পরিবারকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে, ক্ষুধা, অপুষ্টি, হতাশা তাদের নিত্যসঙ্গী হয়েছে।
করোনার সময় লকডাউন থাকায় গরিব নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বড়ো অংশ জীবিকা থেকে চ্যুত হয়ে পরিবার স্বজন নিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছে। এদের মধ্যে আছে বিভিন্ন কারখানার কর্মচারী (পোশাক শিল্পে বেশি), রিকশা-ভ্যান চালক, শিক্ষকতা করে জীবিকা উপার্জনকারী, ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন সেলুন, লন্ড্রি, ডেকোরেটার্স, ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ হকার, শহরের কাজের বুয়া, দিনমজুর, নানা ধরণের ফেরিওয়ালা, মুটে মজুর, নির্মাণ শ্রমিক প্রভৃতি। এরা সরকার থেকে তেমন সাহায্য পায়নি। শহরের ঘরভাড়া, দৈনন্দিন জীবনযাপনের খরচ, চিকিৎসা খরচ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতির ব্যয়ের সাথে তারা সামাল দিতে পারেনি। সঞ্চয় ভেঙেছে, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করেছে, পরে চোখের জলে সামান্য তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রামের পথ ধরেছে। আবার গ্রামের গরিব লোক, মজুর, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যবসায়ী, কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, চা-শ্রমিক, বেদে সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ও দলিত সম্প্রদায়ের নানা বর্গের লোকের জীবনযাপন এই করোনার সময় বিপুলভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। লকডাউন উঠে গেলে অনেকে কাজের সন্ধানে রাজধানী, বড় শহর ও গঞ্জে চলে গেছে, কেউ পেয়েছে কেউ কাজ পায়নি, এক অনির্দেশ্য জীবনে ভেসে চলেছে এক বড় জনগোষ্ঠী। গত আগস্টে সরকারি এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা ১০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০.৫ শতাংশ হয়েছে অর্থাৎ দ্বিগুণ বেড়েছে হতদরিদ্রের সংখ্যা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯.৪ শতাংশে গেছে। যদিও সিপিডি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি দরিদ্রের সংখ্যা আরো বেশি বলছে। বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ৬৮ শতাংশ মানুষ অতিমারির কারণে জীবিকা হারিয়েছে, এর মধ্যে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৭১ শতাংশ। অন্য এলাকায় এই সংখ্যা প্রায় ৬১ শতাংশ (সূত্র: ডেইলি স্টার, ৪ জানুয়ারি-২০২১)। অন্যদিকে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্নেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ যারা এই সময়ে তাদের ইনকাম খুইয়েছেন, অথবা চাকরি কিংবা জীবিকা নেই তারা কোন প্রকার সরকারি সাহায্য পাননি।
কেবল ৩৯ শতাংশ মানুষ সরকারি সাহায্য পেয়েছেন- যেটি তাদের হারানো আয়ের ৪ শতাংশ মাত্র। যেখানে জিডিপি বৃদ্ধির কথা ছিলো ৮ শতাংশের ওপর, সেখানে হয়েছে মাত্র ৩.৮ শতাংশ। তবে এটা সত্য যে, করোনা সংক্রমণের কয়েক মাস পর অর্থাৎ আগস্ট- সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোয়া লাখ টাকার প্রণোদনার ফলে জীবন-জীবিকার সংগ্রাম আবার একসঙ্গে শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে আগামী বাজেট এবং বার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় করোনার প্রভাবকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। কৃষি উৎপাদনে সাফল্য অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে অবদান রাখছে বিনিময়ে কৃষকরা পাচ্ছে সামান্যই।
পোশাক শিল্পের পরিস্থিতিও উন্নতি হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এত দুর্বিপাকের মধ্যেও গত বছরের তুলনায় বেশি এসেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসা প্রায় ৪ লাখ লোক এখন বেকার জীবন অতিবাহিত করছেন।
সরকারের বড় প্রকল্পগুলি চলছে কিন্তু দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম অর্থনীতি ও সুশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আয় ও ভোগ বৈষম্য প্রবল হচ্ছে। এটা নিউ নরম্যাল ইকনমির ধর্ম হতে পারেনা। এখন প্রয়োজন বৈষম্য কমাতে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তদের সুযোগ সুবিধা, আয় বণ্টন ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় অধিক সম্প্রসারিত করা। সরকারি প্রণোদনা, ঋণ সাহায্য ধনিকদের একচেটিয়া হলে তা ফল দেবেনা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে প্রাধান্য না দিলে গ্রামের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে না।
বেশ কিছু শিক্ষার্থী যারা টিউশন করে শহর, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তারা গ্রামে চলে গেছেন। আবার পড়াশোনায় ফিরতে হলে তাদের আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। গ্রাম শহরের দরিদ্র অভিভাবকদের আর্থিক সাহায্য কিংবা জীবিকার ব্যবস্থা করতে না পারলে তাদের সন্তানরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়বে।
করোনার সময় মানসিক ট্রমা ও অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন। দুর্নীতি, অপরাধ, মাদক এখন অপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে, আবার এর হোতারা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে শক্তিশালী, প্রতিপত্তিশালী।
বড় বড় প্রকল্পের কারণে অর্থনীতির ভিত শক্ত হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক ভিত শক্তিশালী না হলে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবেনা, বৈষম্যও কমবেনা। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈষয়িক সমৃদ্ধির পরও সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হওয়ায় যুদ্ধ-সংঘাতে পড়েছে, খ- খ- হয়ে গেছে, অনেক দেশ নয়া-ঔপরিবেশিক শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছে। এ জন্য চাই রাজনীতি ও সমাজের গুণগত পরিবর্তন নিউ নরম্যাল সোশ্যাল অর্ডার এর এটিই প্রধান বিবেচ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। আবার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ, সহনশীলতা, রাজনৈতিক সুস্থিরতা না থাকলে সামাজিক বিপন্নতা অস্থিরতা রোধ করা সম্ভব হবেনা। সকল প্রকার বৈষম্যের গ্রাম-শহর, অঞ্চল, জনগোষ্ঠী অবসান করতে না পারলে কোভিড পরবর্তী সময় অস্থিরতার আবর্তে নিক্ষিপ্ত হবে। কাজ হারানো, জীবিকা হারানো নি¤œবিত্ত, গরিব ও দলিত জনগোষ্ঠী প্রতিবাদ মুখর হবে জীবন-জীবিকার দাবিতে। তাই সরকারের আগামী অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বৈষম্যের অবসানে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে। কর্মসংস্থানের প্রকৃত চিত্র থাকতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও জীবন জীবিকাকে পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক