সুপ্রভাত ডেস্ক »
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বৃহস্পতিবার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যার মূল বিষয়বস্তুই ছিল মহাকাশে এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে নাকি নেই? সারা পৃথিবীর অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে ছিলেন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই রিপোর্টের দিকে। খবর বিবিসি বাংলা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব একটা সন্তোষজনক কিছু মিলেনি প্রতিবেদনে। অর্থাৎ এলিয়েনের উপস্থিতির তারা কোন প্রমাণ পান নি; কিন্তু আবার সম্ভাবনা উড়িয়েও দিতে পারছে না নাসা।
দীর্ঘ ১ বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার পর ৩৬ পৃষ্ঠার যে রিপোর্ট দিলো নাসা, তার অধিকাংশই বিভিন্ন কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পূর্ণ।
এই রিপোর্টে যাবার আগে তাই কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আগে পরিষ্কার ধারণা প্রয়োজন। আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট; সংক্ষেপে ইউএফও। বাংলায় যেটাকে অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বলা যেতে পারে।
মহাকাশে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন যেসব বস্তুর নড়াচড়া চোখে পড়ে বলে দাবি করা হয়, সেগুলোকে ইউএফও হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
এই ইউএফও নিয়ে মানুষের আগ্রহ বহুদিন ধরে। কেউ কেউ চমক লাগাতে বলে থাকেন এগুলো আসলে এলিয়েনদের বাহন।
কোন প্রমাণ না থাকলেও দুনিয়াজুড়ে এই ইউএফও’র অস্তিত্ব বিশ্বাস করার লোকেরও অভাব নেই। প্রচুর ভিডিও গেমস আর চলচ্চিত্রে এই ইউএফওর উপস্থিতি পাওয়া যায়।
এই ইউএফও’কে মার্কিন স্পেস এজেন্সি নাসা বলে থাকে ইউএপি বা আনআইডেন্টিফাইড অ্যানাম্যালাস ফেনোমেনা। বাংলায় বলা যেতে পারে অশনাক্ত অস্বাভাবিক ঘটনা।
এখন এই ইউএফও বা ইউএপি যেটাই বলি না কেন, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে গত বছর এক আলাদা গবেষক দল নিয়োগ করে নাসা।
১৬ সদস্যের এই দল গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু করে গবেষণা। যাদের উদ্দেশ্য ছিল এই বিষয়টি নিয়ে যেভাবে নানা চাঞ্চল্যকর আলোচনা হয়ে থাকে, অর্থাৎ আসলেই পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি-না সেসব বিজ্ঞানের মাধ্যমে জানা।
এ গবেষণায় কী পেলেন তারা সেটাই তুলে ধরা হয় নাসার এই ইউএপি স্টাডি রিপোর্টে।
এই রিপোর্টের একেবারে শেষ পাতায় বলা হয়েছে ‘এরকম উপসংহারে আসার কোন কারণ নেই’ যে শত শত যেসব ইউএপি নিয়ে নাসা তদন্ত করেছে সেগুলো দেখা যাওয়ার পেছনে কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর হাত আছে।
‘তবে যাই হোক…এসব বস্তু আমাদের সৌরজগতের ভেতর দিয়েই ভ্রমণ করেছে এখানে পৌঁছাতে,’ রিপোর্টে বলা হয়েছে।
যদিও রিপোর্টে বলা হয়নি যে বহির্জাগতিক কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে, কিন্তু নাসা আবার এই ব্যাপারটা অস্বীকারও করেনি যে সম্ভবত পৃথিবীর অভ্যন্তরে অজানা কোন এলিয়েন প্রযুক্তি হয়তো কাজ করে চলেছে।
তবে নাসার প্রশাসক বিল নেলসন স্বীকার করেন বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহ থাকতে পারে।
আপনি যদি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেন যে এই বিশাল সৌরজগতে অন্য প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি-না আমি বলবো হ্যাঁ, বলেন মি. নেলসন।
তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে খোলামেলা ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কাজ করবেন তারা।
নিকোলা ফক্স, নাসার বিজ্ঞান মিশন অধিদপ্তরের সহযোগী প্রশাসক, বলেন: ‘ইউএপি আমাদের এই গ্রহের অন্যতম বড় এক রহস্য।’ আর এর প্রধান কারণ হল এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যের অভাব।
যদিও প্রতিনিয়ত অসংখ্য ইউএপি দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু মি. ফক্স বলছেন আমাদের হাতে আসলে পর্যাপ্ত তথ্য নেই ‘যার সাহায্যে আমরা সুনিশ্চিত বৈজ্ঞানিক সমাপ্তি টানতে পারি যে এই ইউএপিগুলো কেমন ও কোথা থেকে আসছে?’
রিপোর্টে বলা হয় বেশিরভাগ ইউএফও ব্যাখ্যা করা গেলেও কিছু পাওয়া যায় যেগুলো মনুষ্যসৃষ্টও না আবার প্রাকৃতিক কারণেও হয়নি।
মি. ফক্স ঘোষণা দেন নাসা ইউএপি গবেষণায় একজন নতুন পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম পরিচয় না জানালেও তার কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি, তিনি একটা বিশদ ডেটাবেজ তৈরি করবেন যাতে ভবিষ্যত ডেটা বিশ্লেষণে সহায়ক হয়।
এই নতুন পরিচালক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে তথ্য যোগাড় ও বিশ্লেষণ করবেন।
বিবিসি রিপোর্টার স্যাম কাবরাল নাসার প্যানেলকে প্রশ্ন করেন, গত সপ্তাহে মেক্সিকান কর্তৃপক্ষের কাছে যেসব কথিত ভিনগ্রহের প্রাণীর বেশকিছু ছবি উপস্থাপন করা হয় সে সম্পর্কে।
জেমি মাওসান, একজন স্বঘোষিত ইউএফও বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি কংগ্রেসের সামনে শুনানিতে হাজির হয়ে দুটি প্রাচীন ‘মানুষ নয় এমন’ এলিয়েনের মৃতদেহ উপস্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন এই দেহ দুটি পেরুর কুসকোতে ২০১৭ সালে মিলেছে, আর রেডিওকার্বন পরীক্ষায় পাওয়া গেছে যে এগুলো অন্তত ১৮০০ বছরের পুরনো।
বিজ্ঞানমহল অবশ্য এই নমুনার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছে, কারণ মি. মাওসান এর আগেও ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে দাবী করেন যা খারিজ হয়ে যায়।
নাসার বিজ্ঞানী ড. ডেভিড স্পারজেল বিবিসিকে বলেন, ‘এই নমুনা গুলো বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা হোক, তাহলে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারবো যে এগুলো আসলে কী?’
ইউএফও পরিচালকের পরিচয় গোপন
নাসার এই বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনের আরেকটি আলোচনার বিষয় ছিল ইউএপি গবেষণার নতুন পরিচালককে নিয়ে।
তার নাম পরিচয় এখনো রহস্যের আড়ালে। তার কাজ এবং বেতন ব্যাপারেও কিছু পরিষ্কার করেনি নাসা।
বিশেষ করে নাসা যখন বলছে যে ইউএপি গবেষণার সবকিছু তারা গোটা দুনিয়ার সাথে খোলাখুলি তুলে ধরবে, তখন তাদের এই আচরণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এর একটা সম্ভাব্য কারণ অবশ্য হতে পারে যে নাসা চাইছে তাদের নতুন পরিচালককে যাতে আগেই জনগণের সামনে কোন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
ড. ড্যানিয়েল ইভান্স, নাসার এই গবেষণার উপ-সহকারী প্রশাসক জানিয়েছেন, তাদের ইউএপি প্যানেল ‘সত্যিকারের হুমকি’ পেয়েছে।
তিনি বলেন নাসা তার দলের সদস্যের নিরাপত্তার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে, আর ঐ হুমকিটা পরিচালকের পরিচয় প্রকাশ না করার পেছনে কাজ করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং ইউএপি শনাক্তকরণের সবচেয়ে জরুরী টুল।
একইসাথে মানুষকে ইউএপির ব্যাপারে জানানোটাও এর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।
নাসা বলছে এই গবেষণায় যে বড় চ্যালেঞ্জ তথ্যের স্বল্পতা, সেটা তারা পূরণ করতে চান সাধারণ মানুষদের যুক্ত করার কৌশল দিয়ে।
এটা হতে পারে উন্মুক্ত স্মার্টফোন অ্যাপ অথবা বিশ্বব্যাপী একাধিক নাগরিক পর্যবেক্ষকের স্মার্টফোনের মেটা ডেটার সাহায্য নিয়ে।
বর্তমানে এমন কোন আদর্শ ব্যবস্থা নেই যাতে মানুষ ইউএপি দেখে সেগুলো সম্পর্কে ঠিকভাবে জানাতে পারে। ফলে রিপোর্টে বলা হচ্ছে ‘এতে তথ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।’