বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে খামতাংপাড়া এলাকায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে আটজনের লাশ উদ্ধার করে শুক্রবার দুপুরে রোয়াংছড়ি থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।
খামতাংপাড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা কেএনএফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও উৎপাতে থাকতে না পেরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর রোয়াংছড়ি ক্যাম্পে চলে এসেছেন। বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী তাঁদের থাকা এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হবে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় তাঁদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, চাঁদা আদায়, ভাগ-বাটোয়ারাকেই সংঘাত-হানাহানির পেছনে মূল কারণ বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা, নাগরিক সমাজ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোও বলছে, হানাহানির পেছনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় যুক্ত রয়েছে। তবে আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে হতাশা থেকে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ে একসময় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নামের মাত্র একটি দল ছিল। এই দলের সঙ্গেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করেছিল সরকার। চুক্তির বিরোধিতা করে প্রথমে একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে নতুন দল করে। পরবর্তী সময়ে দুটি দল ভেঙে এখন চারটি দল হয়েছে।
মূলত চাঁদাবাজি নিরঙ্কুশ রাখতে এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার, মতের ভিন্নতা আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন-খারাবি ও অপহরণসহ নানান অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে এসব সংগঠন। আবার পাল্টা ‘প্রতিশোধ’ নিতেও খুন করা হচ্ছে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের। চার সংগঠনের সশস্ত্র সংঘাতে তাদের নিজেদের নেতাকর্মী-সমর্থক, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও খুনের শিকার হচ্ছেন।
নিজেদের নিয়ন্ত্রণে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় যেকোনো সময়েই প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের হত্যা করা ‘মামুলি বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সগোত্রের অস্ত্রধারীদের হাতে পাহাড়ি লোকজন ‘টার্গেট কিলিং’ এর শিকার হচ্ছেন। এতে আতংকের জনপদে পরিণত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নিরাপত্তার অভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দুই জেলার পর্যটন ব্যবসার খাতেও।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখ- নিয়ে গঠিত তিন জেলার মোট আয়তন ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা মাত্র ১৬ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ বাঙালি আর বাকি ৮ লাখ ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে এর সুফল দৃশ্যমান করতে হবে পার্বত্যবাসীর কাছে।
শান্তি ফেরার কথা ছিল যেখানে ২৫ বছর আগে, সেখানে এখনো সংঘাত থামেনি। দেশের স্বার্থে উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিতে তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ফেরাতেই হবে।
এ মুহূর্তের সংবাদ