সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক ফেসবুক ও ইউটিউবে বিকল্প বা ব্যতিক্রমী চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তারদের একটি সংগঠনের রোষানলে পড়েছেন।
জাহাঙ্গীর কবিরের বিরুদ্ধে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর) ‘অবৈজ্ঞানিক, অসত্য ও সম্মানহানির’ বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ তুলে নোটিশ পাঠিয়েছি।
তাদের নোটিশে বলা হয় সাতদিনের মধ্যে, তাদের ভাষায়, ‘বিভ্রান্তিকর ও অবৈজ্ঞানিক’ ভিডিও কনটেন্ট অনলাইন থেকে না সরালে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শুধু তাই নয়, তারা এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলেও অভিযোগ করেছেন।
এফডিএসআর এর এই চাপের মুখে জাহাঙ্গীর কবির ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, তিনি নিজেকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করেন না।
”আমার কথায় হয়তো অনেক সহকর্মী – সিনিয়র চিকিৎসক কষ্ট পেয়েছেন কিংবা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। আমি তাদের সবার প্রতি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা প্রার্থী,” মঙ্গলবার দুপুরের দিকে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পাতায় দেয়া এক বক্তব্যে জাহাঙ্গীর কবির বলেন।
জাহাঙ্গীর কবির যেভাবে আলোচনায় আসলেন
প্রচলিত ধারার চিকিৎসার তুলনায় একটু আলাদা ধরনের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে গত কয়েক বছরে আলোচিত হয়ে উঠেছেন জাহাঙ্গীর কবির।
তার ইউটিউব পাতায় যেসব ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, সেখানে ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, জীবনধারা পরিবর্তন, সেক্স হরমোন বাড়ানোর উপায় ইত্যাদি পরামর্শ রয়েছে।
ফেসবুকে তার ভেরিফাইড পাতায় দুই মিলিয়নের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। ইউটিউবেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০০ সালে স্নাতক পাস এই ডাক্তারের ফলোয়ারের সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি।
”সুস্থ থাকার লক্ষ্যে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা নিয়ে কাজ করছি,” তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন মিঃ কবির।
”সেই লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন ধরে আমার রোগীদের লাইফ স্টাইল মডিফিকেশনের পরামর্শ দিয়ে আসছি।’
জাহাঙ্গীর কবির স্বীকার করেন যে সম্প্রতি তার ‘একটি ভিডিও এবং দুইটি পোস্ট’ নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্য ডাক্তাররা কী অভিযোগে করছেন?
রবিবার জাহাঙ্গীর কবিরের ঠিকানায় এফডিএসআর-এর যে চিঠি পাঠানো হয়, তাতে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি বিভিন্ন চিকিৎসকের দেয়া প্রেসক্রিপশনকে হেয় করে মন্তব্য করেছেন।
ডাক্তারদের উক্ত সংগঠন আরো অভিযোগ করে যে, তিনি টিকা নিয়ে ইম্যুনোলজি বিষয়ক ভুল বক্তব্য দিয়েছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ”আপনি সম্প্রতি বলেছেন, কোভিড ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করানো হয়। আরো বলেছেন, ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিন দরকার। এ রকম ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে আপনি আপনার অজ্ঞতাপ্রসূত পোস্ট মারফত কোটি কোটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন, যা জন বিরোধী কাজ।”
ডাক্তারদের তোপের মুখে পড়া চিকিৎসক তার ফেসবুক পাতায় স্বীকার করেছেন যে তিনি ভ্যাক্সিন সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।
”সুস্থ থাকার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে আমি একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলাম সেখানে করোনার ভ্যাক্সিন বিষয়ে কিছু তথ্য সহজভাবে বোঝাতে গিয়ে আমার অসাবধানতাবশতঃ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম.” তিনি বলেন।
”এ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হলে আমি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভিডিওতে যে তথ্যগুলো ভুল ছিল এবং যে কথাগুলো জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে পূর্বের ভিডিওটি অনলাইন থেকে সরিয়ে দিয়েছি।”
চিকিৎসকদের নিয়ে ব্যঙ্গ?
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এফডিএসআরের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন অভিযোগ করেন যে, জাহাঙ্গীর কবিরের চিকিৎসা ব্যবস্থা ”বিজ্ঞানভিত্তিক যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে নয়।”
”দেখা গেছে, যারা প্রকৃত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, তাদের চিকিৎসারও নানারকম ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা করেছেন। সেটার জন্য আমরা ক্ষমা চাইতে বলেছি,” তিনি বলেন।
তবে ব্যঙ্গ করার কথা অস্বীকার করেছেন জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেছেন, যথেষ্ট সম্মানের সাথেই অন্য চিকিৎসকের প্রসঙ্গ তার পরিবেশনায় ব্যবহার করা হয়েছে।
তার ফেসবুক পাতায় তিনি বলেন, অন্য একটি জনসচেতনতামূলক পোস্টে উদাহরণ স্বরূপ একটি প্রেসক্রিপশন শেয়ার করেছিলেন।
”ঐ প্রেসক্রিপশনটি যিনি লিখেছিলেন তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক আমি তার নাম ও রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটি প্রকাশ করিনি। তথাপি এই পোস্টটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তৎক্ষণাৎ দুটি পোস্টই ডিলিট করে দেই,” তিনি বলেন।
কিটো ডায়েট ক্ষতিকর?
ডাক্তারদের সংগঠর তাদের চিঠিতে দাবী করে, কবির জাহাঙ্গীরের চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
”আপনি আপনার কোন লেখায় বা বক্তব্যে আপনার সেবাগ্রহীতাদের কিটো ডায়েটের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে লিখিত বা মৌখিক কাউন্সেলিং করেন না,” চিঠিতে বলা হয়।
”এই ডায়েটের ফলে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদী যেসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে, সেটা নিয়ে আপনি কখনো রোগীদের অবগত করেন না। এটা ম্যালপ্র্যাকটিস।”
”আমরা মনে করি, যে সমস্ত ক্রনিক রোগের ক্ষেত্রে উনি যেভাবে বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে সেটা তাদের জন্য অনেক ক্ষতিকর হতে পারে এবং হয়ে থাকে,” চিঠিতে বলা হয়।
”সেই শঙ্কা থেকে তাকে বলা হয়েছে, একজন তালিকাভুক্ত চিকিৎসক হিসাবে তিনি যেভাবে চিকিৎসা করছেন, সেটা নৈতিকভাবে ঠিক নয়।”
জাহাঙ্গীর কবিরের আপলোড করা যেসব জিনিস এফডিএসআর রোগীদের স্বাস্থ্যের জন্য ”ক্ষতিকর” বলে মনে করছে, চিঠিতে সেগুলো ‘সাতদিনের মধ্যে’ সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
বিএমডিসিতে অভিযোগ
এফডিএসআর মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলছেন, তার ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে অভিযোগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার পর প্র্যাকটিস করতে হলে এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিতে হয়। চিকিৎসকদের কর্মকাণ্ড তদারকি, অভিযোগের নিষ্পত্তিও এই প্রতিষ্ঠানটি করে থাকে।
বিএমডিসি যদি এক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এফডিএসআরের আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলেও ঘোষণা করেছে।
তবে মি. কবিরও তার ফেসবুক পাতায় দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, নিজের ভুলকে ভুল হিসেবে গ্রহণ করে তা শুধরে নেবেন। ”আপনাদের কাছেও আমার অনুরোধ আপনারা আমার পূর্বের ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন,” তিনি লিখেছেন।
সূত্র : বিবিসি