নিজস্ব প্রতিবেদক »
নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়ার সাদ্দাম এবং নাসরিনের প্রথম সন্তান ইয়াছিন আরাফাত। বয়স তার ১৮ মাস। খেলতে গিয়ে নালায় পড়ে যায় শিশুটি। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে গতকাল সকাল ৯টার দিকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। একমাত্র সন্তান হারিয়ে কিছুতেই কান্না থামছে না ইয়াছিনের বাবা-মার। অথচ নালা পরিষ্কারের কোনো দায় নিতে রাজি নয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
শিশুটির উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘যে নালায় শিশুটি পড়ে গিয়েছিল, তার পাশের ভবনের সংযোগ নালা থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নালার আর্বজনায় আটকে ছিল শিশুটি। গত ২৬ আগস্ট বিকেলে শিশুটি নালায় পড়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ (২৮ আগস্ট) সকাল থেকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সহায়তায় নালার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। এ সময় সকাল ৯টা ১০ মিনিটের সময় শিশুটির মরদেহের সন্ধান পায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল ও চসিক কর্মীরা। নিখোঁজের প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে।’
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু ইয়াছিনের বাড়ির পাশেই একটি নালা। নালাটির কিছু অংশে নিরাপত্তা দেয়াল দেওয়া হয়েছে। কিন্ত ৬ থেকে ৭ ফুট অংশে কোনো দেয়াল নেই। সেখানেই ইয়াছিন পড়ে যায়। অথচ সে নালা ঘেঁষে প্রতিদিন মোল্লাপাড়া, মুড়িপাড়ার হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। স্থানীয়রা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনের (চসিক) দায়িত্বহীনতায় মারা গেল শিশু ইয়াছিন।
আবদুল মিয়া নামে এক স্থানীয় বলেন, ‘সময় থাকতে নালা পরিষ্কার করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বহুবার বলা হয়েছে নালা পরিষ্কার করে দিতে। কিন্ত কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী আসেনি। একবছর ধরে পরিষ্কার করতে দেখা যায়নি কাউকে। নালাতেও কোনো স্ল্যাব দেওয়া হয়নি। নালা ঘেঁষে ছোট পথ ধরে হাজার হাজার লোক আসা-যাওয়া করে। তবুও নালাটি অরক্ষিতভাবেই রয়েছে। এভাবে আর কতদিন চলবে।’
এ প্রসঙ্গে নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক বলেন, ‘দুর্ঘটনা যা ঘটুক। সকল দায় তো আমাদের নিতে হবে। আমরা দায় নিতে কোনো ধরনের কার্পণ্য করি না। তবে দায় আমার যেমন রয়েছে, তেমনি জনসাধারনেরও নিতে হবে। যেমন নিজেদের ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে রাখা।’
ময়লা পরিষ্কার না-করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করি। চসিকের যে কয়জন সেবক নালা পরিষ্কার করে তারা একটি চার্ট অনুযায়ী তা করে। একবার এ এলাকা, আরেকবার অন্য এলাকা। আমার এলাকায় আমি তো নিজে পরিষ্কার করি না। এই ময়লা পরিষ্কার করার জন্য চসিকের একটি শাখা আছে। এই বিষয়টি সেখান থেকেই দেখাশোনা হয়। আমি কাউন্সিলর হয়ে অপরিষ্কার নালাগুলোর শিডিউল দিয়ে দিই। পুরো বিষয়টি আমার এখতিয়ারে নেই।’
জানা যায়, চলতি বছরের বর্ষা শুরুর আগেই নগরের সব নালা ও ড্রেনের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নেয় সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্ব সংস্থাটির প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম এবং বর্জ্যব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলীর। এ বিষয়ে জানতে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে বর্জ্যব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, ‘ড্রেন পরিষ্কার আমাদের নিয়মিত কাজ। এরপরও আমরা ড্রেন পরিষ্কারের জন্য এই প্রকল্পটি নিই। প্রতিটি ওয়ার্ডে ড্রেন পরিষ্কার করার মাধ্যমে ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার প্রকল্পটি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। নালায় পড়ে যে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে, সেটির দায় তার বাবা-মাকে নিতে হবে। কেননা বাচ্চা খেলতে খেলতে ড্রেনে পড়ে যাবে, তা হতে পারে না। শিশুটিকে সামলে রাখা উচিত ছিল তার বাবা-মায়ের।
প্রসঙ্গত, অরক্ষিত নালায় পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে নগরে। ২০২১ সালের ৩০ জুন নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকার চশমাখালে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা পড়ে গিয়ে দুজনের মুত্যু হয়। একই বছরের ২৫ আগস্ট নগরীর মুরাদপুর মোড়ের নালায় তলিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন সালেহ আহমেদ নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। ঘটনার পর টানা কয়েকদিন অভিযান চালিয়েও তাঁকে উদ্ধার করতে না পারায় একপর্যায়ে তৎপরতা বন্ধ করে দেয় ফায়ার সার্ভিস। দুবছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর মরদেহের খোঁজ মেলেনি আজও। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় ১৯ বছর বয়সী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া নালায় তলিয়ে যান। চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথমবর্ষের এই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ হবার দিন রাতের বেলায়। এছাড়া চলতি বছরে ৭ আগস্ট নালায় পড়ে নিপা পালিতের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল (২৮ আগস্ট) ইয়াছিন নালায় পড়ে মারা যায়। এভাবে গত সাত বছরে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের।