অভীক ওসমান »
(গত সংখ্যার পর)
তারা আমাকে একটা নাটক লিখতে বলে। আমি আবেগে কাঁপতে থাকি। সৃষ্টিতে ঊীপরঃবফ জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা পুড়ছে, সমাজে অবক্ষয়ও শুরু হয়েছে। ‘সুবচন নির্বাসন’ নাটকটি পুরো বাংলাদেশের মঞ্চ দখল করে ফেলেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি-সংস্কৃতির বহু পোড় খাওয়া আমাদের বাসা ৪৯, ঘাটফরহাদবেগে আসলাম। আফগান বিল্ডিংয়ে গিয়ে লিখি আমার প্রথম নাটক ‘তিরোহিত সুন্দর আমার’। আশ্চর্য ধন্য ধন্য রব। সবার পছন্দ হয়ে গেল। প্রথমে সোলায়মান কেন্দ্রীয় চরিত্রে রিহার্সাল করেন। পরে তিনি নির্দেশক, তখনকার গ্রুপ থিয়েটারের মেধাবী রোমান্টিক নায়ক প্রশান্ত রক্ষিত মূল চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। এস.এম. সোলায়ামানের নির্দেশনায় প্রশান্ত রক্ষিতের অভিনয়ের জন্য আমার প্রথম লেখা নাটক একটি বিশেষ মাত্রা ও মর্যাদা লাভ করে। আমি গর্ববোধ করি। সব মিলিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৭ জুলাই, ১৯৭৫ মুসলিম হলে নাটকটি প্রথম ও সফল মঞ্চায়ন হয়।
সোলায়ামান শুধু ঝঃঁফবহঃ খবধফবৎ গায়ক, শিল্পী ছিলেন না। চট্টগ্রাম কলেজে চড়ষরঃরপধষ ঝপরবহপব এর একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অনার্সে তিনি ভাল ফলাফল করেন। মিষ্টি মনকাড়া চেহারা ছিল। চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলতেন। অসম্ভব ভালবাসতেন বন্ধুদের, মানুষদের উদারভাবে, অকাতরে। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে আমাদের ছেড়ে তিনি ঢাকায় মাইগ্রেট করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ভর্তি হন। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সবাইকে অতিক্রম করে এস. এম. সোলায়ামান হয়ে উঠলেন একজন বড়ো মাপের ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার। এখানেই আমাদের গর্ব।
নাটককে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। প্রহসনের মাধ্যমে আমাদের বুর্জোয়া সমাজে চাবুক মেরেছেন।
মূলত সেলায়মানের হাতে আমাদের নাটকের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে আমরা গঠন করি গ্রুপ থিয়েটার গণায়ন। তিনি ঢাকায় গঠন করেন কালান্তর, পদাতিক নাট্য সংসদ, ঢাকা পদাতিক ইত্যাদি। তার সাথে চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে যুক্ত হন আমার উত্তরসূরি বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম সিটি কমিটির সাহিত্য সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক জোট নেতা। চট্টগ্রাম কলেজের কাউসার চৌধুরী; আমার ‘তিরোহিত সুন্দর আমার’ ২য় প্রযোজনার অভিনেতা ৭০-এর কবি কাজী রফিক। নাটকের নাড়ীটাই ছিন্ন হয়নি। গণায়ন পরবর্তীতে সোলায়মানের লেখা ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’ মঞ্চস্থ করেছে। গণায়ন বাংলাদশের প্রথম পথ নাটক ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ মঞ্চস্থ করে। এস.এম. সোলায়মান ক্ষ্যাপা পাগলাসহ বেশকটি গণ নাটকের রচয়িতা। আমি নিজেও রচনা করি ‘অবশেষে জেনারেল’। গণমানুষের মুক্তির জন এস.এম. সোলায়মান ও আমাদের কমিটমেন্ট এক ও অভিন্ন গণায়নের ম. সাইফুল আলম তার সাথে যৌথভাবে রচনা করেন ‘ঘোড়া এলো শহরে’। গণায়নে মঞ্চস্থ মানসম্পন্ন নাটকের মধ্যে এটি একক।
সোলায়মান যেমন তার প্রথম নাটক মঞ্চায়ন না হওয়াতে ১৯৭৫ সালে আমাদের অভিমান অভিযোগ করেননি। অনুরূপ আরেকটি ঘটনা।
লোককাহিনী অবিলম্বে যে তিনটি নাটক রচনা করেছিলেন সোলায়মান তা মৌলিক রচনা হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাকে। এক্ষেত্রে কাহিনীসূত্র কেবল লোককথা থেকে আহরিত, এর নাট্য রূপায়ণ একান্তভাবেই সোলায়মানের। এমনি এক নাটক ‘আমিনা সুন্দরী’- যার অবলম্বন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত লোকগাথা যেটি সংগৃহীত হয়েছিল গবেষক আশুতোষ চৌধুরী কর্তৃক। আমিনা সুন্দরীর এই পালা সোলায়মান ঢেলে সাজালেও সংগ্রাহক- পুত্র খ্যাতনামা গল্পকার ও সঙ্গীতজ্ঞ তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন, গ্রন্থস্বত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে ভেবে আইনের শরণাপন্ন হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংগ্রামী সোলায়মান লোক-ঐতিহ্যের সর্বজনীন স্বত্ব নিয়ে কোন বিবাদে লিপ্ত হতে চাননি; শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজের অভিমত মান্য করে তার রচনার নাম পাল্টে করেছিলেন ‘সাকিনা সুন্দরী’।
প্রিয় পাঠক, এটি এস.এম. সোলায়মানের নাটক ও কর্মের বিশ্লেষণমূলক গদ্য নয়। কিঞ্চিৎ স্মৃতি কাতরতা-এলিজি। একজন সৎ নিবেদিত প্রাণ নাট্যকার, চট্টগ্রামের সন্তান এস.এম. সোলায়মান কথা এখানেই শেষ করছি। এই সাথে চট্টগ্রামের অমর লোক কাহিনী নছর মালুম ও ভেলুয়া সুন্দরী অবিলম্বে রচিত ‘আমিনা সুন্দরী’ নাটকের দুটা সংলাপ পেশ করছি-
হায়রে নসিব, ললাটের লিখন না যায় খণ্ডন। আল্লার দুনিয়ায় কোন দোষ করছিলাম আল্লাই জানে। জীবন তো মানুষের একটাই। আজ আছে কাল নাই। তয় এত ডর লাগে ক্যান? দশ বছর পরে খসমের লগে পরথম দেকা।
আর কিছু না, প্রশ্ন একটাই। এই শরীরের সন্তিপনা বজায় ছিল তো? হায়রে শরীর, আর তোর সন্তিপনা। এর প্রতি মাইনসের এত লোভ? আইচ্ছা মরণের পর কই যায় মানুষ? কেমন লাগে ঐ কব্বরে। একটা মানুষকে গোরে থুইয়া বেবাকে বাড়ির পান্থে পা বাড়ায়। কব্বরে। ঘুইঘইটা আন্ধার কব্বর। একা একদম একা একজন মানুষ। তারপরে এক দুই তিন। পরে।
হায়রে সাধের শরীর। কিল বিল করে পোকা। ওহ্ কি যে দুর্গন্ধ। মাটির নিচে বীভৎস মাংসের দলা। এখানে ওখানে টুকরা টুকরা। হাওয়া বাতাস নাই সাদা কাফন হাতছানি দিয়ে ডাকে। আয় ফিরে আয় শেষ জীবনের যাত্রায়। হায়রে সাধের মানব জীবন।
পারে লয়ে যাও আমায়। আমি অপার হয়ে বসে আছি ওরে দয়াময়।
আইচ্ছা। ঐ যে শুকতারাটা। দূরে ? কত দূরে ? কত দূরে ? কত রাইত ঐ শুকতারার দিকে চাইয়া চাইয়া ভাবছি জীবনের কথা। এ কেমন জীবন? সোয়ামীর সন্তিপনার আবদার রাখতে গিয়া নিজের তো বার দশা করছি। আর হে? ঠিকই দশটা বছর গায়ে নানান কিছিমের বাতাস লাগাইয়া ঘুরছে। আর আমি? আইজ বাদে কাল যখন মরুমই কয়দিন থাকবো শোকের আয়ু?
কয়দিন? বড় জোর তিন মাস? হের পরে সাইজা আর এক সুন্দরীর সন্ধানে যাত্রা।
সোলায়মান সংসার করেছিলেন। কিন্তু আপাদমস্তক বোহেমিয়ান সোলায়মান সে বন্ধনে আবদ্ধ থাকতো না। জনারণ্যে একাকীত্বের এক নির্জন প্রান্তরে সে ঘুরে বেড়াতে ভালাবাসতো। তাহলে কি সে উৎপল দত্তের সংলাপের মতো আমি দেবতার মতো, ঘৃণার মতো, অবজ্ঞার মতো একাকীত্বকে ভালোবেসে ফেলেছিলো? আমিনা সুন্দরীরও কি এই আর্তি?