ড. আনোয়ারা আলম »
বেশ ভালো আছেন আমাদের ব্যবসায়ীরা। যতো বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধ বা মহামারি! বা উৎসব! ততো বেশি মহানন্দে থাকেন উনারা। জনগণের দুঃখ দুর্দশা তাঁদের মনে একটুও প্রভাব ফেলেনা। মানবতা ওদের কাছে অতি তুচ্ছ। এমনকি জীবনের যে এক মুহূর্তেরও বিশ্বাস নেই তাও ভাবে না।
দেশে এখন ডেঙ্গু মহামারির রূপ নিয়েছে। ডাক্তার ছেলের ডেঙ্গু হওয়ার পরে উপলব্ধি করলাম ডেঙ্গু আক্রান্ত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী কি মানবেতর ঝুঁকিতে। ডেঙ্গুর ঔষধ শুধু নাপা। পাঁচ টাকার একটা নাপার দাম বিশ টাকা। ডাব! আকাশ ছোঁয়া দাম।আমরাই হিমশিম খাচ্ছি। তাহলে!!
এতো নিষ্ঠুরতা!
ব্যবসায়ী মাত্রের লাভ করার ন্যায্য অধিকার আছে। কারণ তিনি ঝুঁকি নেন, টাকা খাটান এবং পরিশ্রম করেন। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরা লোভী, নীতিবোধ অবলুপ্ত এবং মুনাফাখোর। লাভের চাইতে লোভের কারণে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলে সংশ্লিষ্ট সবাই একজোট। এখানে ধর্ম নৈতিকতা বা মূল্যবোধ সবই তুচ্ছ। কিন্তু বাইরে তিনি কথাবার্তায় একেবারে বকধার্মিক। অনেক কালোটাকার মালিক বা অর্থ পাচারকারী যখন মঞ্চে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন তখন ইচ্ছে হয় গলায় ফাঁস দেই। সমাজটা এমন হয়ে গেছে এদের অনেককে আমরা বিভিন্ন সভা-সমিতিতে দেবতার আসনে বসাই। হুজুর হুজুর করি।
সত্যের খাতিরে বলতে হয় অন্যায়ের প্রবৃত্তি আমাদের অনেকের ভেতরে আছে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের এগুলো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে।
কেন তাদের এতো দৌরাত্ম্য! কেন এতো বেপরোয়া তারা। এর অন্যতম কারণ প্রথমত আইন শৃঙ্খলার শিথিলতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
একইসাথে সামাজিক ভয় বা লোকভয়ের অভাব। একটা সময়ে সামাজিক শাসন ছিল। কেউ দুর্নীতি বা ব্যবসায়ে অতিরিক্ত মুনাফা লোভী হলে সমাজ তাদের বয়কট করতো কিন্তু বর্তমানে সমাজের নেতৃত্ব তাদের হাতে। বিত্তশালীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত; তারা নিন্দিত না বরং সমাদৃত হচ্ছে।
কেন এই সামাজিক অবক্ষয়! কেন এতো দৌরাত্ম্য তাদের। অতীতে অধিকাংশ মানুষের ভেতরে ধর্মবোধ বা শুভবোধ মনের ভেতরে কাজ করতো। একটা সময়ে গোয়ালারা দুধে পানি মেশানোর সময়ে চিন্তা করতো, পানি মেশালে বাছুর মারা যাবে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে এসব এখন কুসংস্কার। অতএব!! অর্থাৎ নতুন যুগের সমাজ- কল্যাণমুখী শিক্ষা এখনো আমাদের ভেতরের কলুষতাকে দূর করতে পারে নি। এক কথায় আমরা ‘ঘরেও নহে,পারেও নহে’ মাঝখানে আছি।
কিভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব!
সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষার সাথে দরকার সমাজকল্যাণ মূলক শিক্ষা দর্শন। একই সাথে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন আইনের সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগের সাথে দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নেওয়া।
আমরা বাজার অর্থনীতিতে আছি অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে যার একটি অমূল্য শর্ত হচ্ছে ক্রেতা কোন খরচা ছাড়াই বাজারের সব তথ্য সম্পর্কে জানে। কোন দ্রব্যের দাম বাড়ানো তাই এতো সহজ হয়না বিক্রেতার কাছে। অর্থনীতির ভাষায় বাজারের এ দামকে বলছে সমস্থিতি মূল্য। কিন্তু এ তথ্যের সাথে বাস্তব ক্ষেত্রে কোন মিল নেই। বরং এটি যেন তত্ত্বের জন্য এটি এক গতানুগতিক প্রহেলিকা। এটির কারণ অর্থনীতিবিদদের মতে পণ্যের দুটি মূল্য আছে। একটি সমস্থিতি মূল্য অন্যটি পণ্যটি তথ্য সম্পর্কের ব্যয় যা ব্যাষ্টিগত ভাবে সম্ভব না। ফলশ্রুতিতে ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নেন।
অনেকের আশা ছিল, ইন্টারনেটের নাটকীয় সম্প্রসারণে বাজার না ঘুরেও ক্রেতারা সহজেই জিনিসপত্রপর দাম জানবেন এবং ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারবেন। বাস্তবে তা ঘটেনি এবং ক্রেতারা বাজার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। আর এ সুযোগটা নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। যুক্ত হয়েছে ভোগবাদীতার সংস্কৃতি। আমরা ক্রেতারা ও কম দায়ী নই। আমরাও কখনো কখনো মজুতদার হয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করি। আর এর লভ্যাংশ যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে। অর্থাৎ ভোক্তাদের ও সুসংগঠিত হওয়া উচিত। যদিও ভোক্তা অধিকার সংগঠনের ক্ষেত্রে ও কিছু নেতিবাচক সংবাদ কানে আসে।
অনেক সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন গণতন্ত্র হচ্ছে অর্থনীতি ও রাজনীতির অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিষেধক। তথ্যের অবাধ প্রবাহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তাই নৈতিক মূল্যবোধহীন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য দরকার সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের একটি কার্যকর উপাদান। একই সাথে দরকার জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেম।