রেলওয়েকে আধুনিক, গতিশীল, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে বড় বড় পরিকল্পনা, নতুন রেলপথ এমন কি মেট্রো রেল, পাতাল রেলপথ, বুলেট ট্রেন-এসব সর্বাধুনিক মাধ্যমের ব্যবস্থাগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে, ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রেল ব্যবস্থাপনা ঔপনিবেশিক আমলের দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ও জট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। রেলওয়ের দুর্নীতিÑঅব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত রেলওয়ে সরঞ্জাম ক্রয় ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি, রেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থতা, নি¤œমানের যাত্রীসেবা ও সঠিক সময়ে গন্তব্যে না পৌঁছা প্রভৃতি। বিদেশ থেকে সরঞ্জাম ক্রয়ে অনিয়মের সর্বশেষ উদাহরণ হলো ক্রয় করা ইঞ্জিন গাছতলায় ডাম্পিং করে রাখা। আমাদের গত বুধবারের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোরিয়া থেকে আমদানি করা ১০টি রেল ইঞ্জিন গত ৭ মাস ধরে পাহাড়তলী ডিজেল শপ এলাকায় বিভিন্ন গাছের তলায় ডাম্পিং অবস্থায় রয়েছে। সাধারণত বিদেশ থেকে আনা ইঞ্জিন ১ মাসের মধ্যে রেললাইনে চালানোর কথা থাকলেও এই নিয়ম মানা হচ্ছেনা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিন আনা হয়নি ফলে এই বিপত্তি।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে ইঞ্জিন সংকট রয়েছে, পুরনো ইঞ্জিনগুলির বেহাল দশা, প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ৩২২ কোটি টাকায় আনা ইঞ্জিনগুলো অযতেœ অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে ইঞ্জিন আনা তা ব্যাহত হচ্ছে, এই ধরণের পরিস্থিতিতেও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এই প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করেছে এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্পের পরিচালক নূর আহমাদ হোসেন সমস্যার বিষয়ে বলেন, ইঞ্জিন তৈরিতে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল, সে শর্ত মানা হয়নি, তা ছাড়া ইঞ্জিন সংগ্রহের পূর্বে প্রি শিপমেন্ট পরিদর্শন করার কথা থাকলেও এসব ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে তিনি আমাদের প্রতিবেদককে বলেন। প্রকল্প পরিচালক এ ব্যাপারে সচিবকে জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করে। অনিয়ম তদন্তে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত (আইন ও ভূমি) সচিবকে প্রধান করে করা কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। আবার এই বিষয়ে ৪ সদস্যের একটি নতুন কমিটি গঠন করেছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক, কারিগরি কমিটির এই রিপোর্ট পাওয়ার পর ইঞ্জিনগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে মর্মে বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কমিটির পর কমিটি করছে, এটি মূলত ব্যর্থতাÑঅনিয়মকে পাশ কাটানোর অভিসন্ধি। রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সূত্রে জানা যায়, ইঞ্জিনগুলোতে যে মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা, প্রকৃতপক্ষে সে মডেল সংযোজন না করে যে মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে তাতে ইঞ্জিনের গতি (হর্স পাওয়ার) ও ব্যাকআপ সিস্টেম কম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। ‘কমিটি কমিটি’ নাটকের আড়ালে অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা আড়ালে পড়ে যাবেন। যেটি রেলওয়ে প্রশাসনের গতানুগতিক ব্যবস্থা।
চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হয়েছে জেনেও রেলওয়ের কর্মকর্তারা কিভাবে ইঞ্জিন সংগ্রহ করলেন তা বোধগম্য নয়। রেলওয়ের সরঞ্জাম, যন্ত্রাংশ ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা সুবিদিত এবং সেসব গণমাধ্যমে প্রায়ই আসে। এ সব নিয়ে কমিটির পর কমিটি হয় কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের কোনোরূপ সাজা হয়না। সরকারি অর্থের অপচয় হয় কেবল। আলোচ্য ক্ষেত্রে অর্থায়ন করেছে বিদেশি দাতা সংস্থা-এতে কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবেনা? দাতারা কি অর্থ যোগানে উৎসাহী হবেন এসব কা- কারখানা দেখে। এর আগে ডেমু ইঞ্জিন নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু আসল রহস্য জানা যায়নি। রেলওয়ের নানা দুর্ঘটনা, অব্যবস্থাপনা নিয়ে অসংখ্য তদন্ত কমিটি হয়েছে কিন্তু সেসব হিমাগারে পড়ে রয়েছে। সুপারিশসমূহ কার্যকর হওয়া কিংবা দোষীদের শাস্তি পাওয়ার দৃষ্টান্ত আছে কি! নিচের দিকে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও উপরের কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই থাকেন। এমন কি অনিয়ম, ভুল, অব্যবস্থাপনা থেকে অভিজ্ঞতা, শিক্ষা নিয়ে শোধরানোর প্রবণতাও চোখে পড়ে না। তাহলে রেল আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় কিভাবে অবদান রাখবে? রেল কি জনবান্ধব, নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবেনা! রেলওয়ে কর্মকর্তারা এসব ভেবে দেখেছেন কী!
মহানগর