সুপ্রভাত ডেস্ক »
আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোতে সফল হতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্পর্কিত ইস্যুতে সমন্বয় ও নেতৃত্ব দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ‘লিড মিনিস্ট্রি’ নির্বাচন করেছে সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক ট্রানজিট/কানেক্টিভিটি পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়নে বাংলাদেশের নজর কয়েক দশক ধরেই। এ উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক ট্রানজিটে ভেড়ার লক্ষ্যে প্রতিবেশী ভারত, ভুটান, নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন উদ্যোগে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু সফলতা আসেনি। এরপর ভুটানকে বাদ দিয়ে ভারত ও নেপালের সঙ্গে নতুন উদ্যোগ (বিআইএন) নেয় সরকার।
বিআইএন উদ্যোগটি চলমান থাকলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। তারও আগে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম), সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (এসএএসইসি), রিজিওনাল ইন্টিগ্রেশন, এশিয়ান হাইওয়েজ, সিল্ক রোড, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। কোনো উদ্যোগই ফল দেয়নি। মুক্ত বাণিজ্যের এই সময়েও জুঁজুর ভয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়নের সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত, একইসঙ্গে বিচ্ছিন্নও।
এদিকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত পথে বাংলাদেশ। ২০২৯ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে পাওয়া সব শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে দেশ। উল্টো বিশ্বকে ডেকে আনতে হবে বাংলাদেশের আঙ্গিনায়। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে করতে হবে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ)। সেখানে সবচেয়ে সহজ উদ্যোগ আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিও (আরটিএ) এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারকে।
উদ্ভূত বাস্তবতায় ভবিষ্যতে আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোতে সফল হতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্পর্কিত ইস্যুতে সমন্বয় ও নেতৃত্ব দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লিড মিনিস্ট্রি নির্বাচন করেছে সরকার।
ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি ইস্যুটি বাণিজ্য সম্পর্কিত হলেও সেখানে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সবাই নিজেকে ‘লিড মিনিস্ট্রি’ মনে করে। ফলে নীতিনির্ধারণী বৈঠকে আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়নে গুরুত্ব হারাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এছাড়া দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দরকষাকষিতে অদূরদর্শিতাও আছে।
বিজনেস অ্যালোকেশন অনুসারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের থাকলেও বাস্তবে এতোদিন সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের মতো করে কাজ করেছে। সে কারণে এসব কার্যক্রমে সামগ্রিক সমন্বয়ের অভাব ছিল। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলোর সম্মতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘লিড মিনিস্ট্রি’ নির্বাচিত হওয়ায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকারের অন্যান্য বিভাগও।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক ট্রানজিট/কানেক্টিভিটি পর্যালোচনা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অংশ নেয় পররাষ্ট্র, নৌ, সড়ক, রেল মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন অংশীজন।
আঞ্চলিক বাণিজ্য উদ্যোগে ব্যর্থতা কোথায়
বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নীতিনির্ধারণী অংশীজনরা তাদের পারস্পরিক মতামত রাখেন। তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি সংক্রান্ত ১৫টি উদ্যোগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন। সেগুলোয় সাফল্য না পাওয়ার পেছনে সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করেছেন তারা।
সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণে এসবের মোটাদাগে অজানা জুঁজুর ভয় এবং সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের হাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার থাকছে না। এখানে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা কাজের ক্ষেত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের মতামত দিচ্ছে। যদিও অংশীজনদের সবাই সরকারেরই অংশ এবং সবার অভীষ্ট লক্ষ্য এক হওয়া সত্বেও বাস্তবে কোনোভাবেই অভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কোনো উদ্যোগেই সাফল্য মিলছে না।
অন্যদিকে ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি ইস্যুটি বাণিজ্য সম্পর্কিত হলেও সেখানে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সবাই নিজেকে ‘লিড মিনিস্ট্রি’ মনে করে। ফলে নীতিনির্ধারণী বৈঠকে আঞ্চলিক বাণিজ্য উন্নয়নে গুরুত্ব হারাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এছাড়া দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দরকষাকষিতে অদূরদর্শিতাও আছে। সর্বোপরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারে অনাগ্রহ তো রয়েছেই।
‘লিড মিনিস্ট্রি’ কেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ওই বৈঠকের একটি কার্যপত্রে বলা হয়েছে, আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ তথা কানেক্টিভিটি ও ট্রানজিট ইস্যুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম/প্রকল্প নেয়া হয়। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশি লাভবান হওয়ার বিষয়টি সব সময় জড়িত থাকে। তাই কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিতে যাওয়ার আগে তা দেশীয় বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করাও জরুরি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের দরকার হয়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক, আন্তঃবাণিজ্য ও আধুনিকায়ন) জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ কাজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় ও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) রকিবুল হক বলেন, ‘কোনো দেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্ত বাণিজ্যের বর্তমান সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার সুযোগ নেই। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোকে ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে অজানা ভয় থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। সে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
‘বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত বিপুল জনসংখ্যার কারণে আমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য ক্ষেত্র হতে পারে। তবে ট্রানজিট/কানেক্টিভিটির বিষয়টি যথাযথভাবে সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করাটা জরুরি। সেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও হতে পারে।’
‘আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য করণীয় সব কার্যক্রম অ্যালোকেশন অফ বিজনেস অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বয় করা হলে তা দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য বিকাশে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা/বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মাহবুবুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে অ্যালোকেশন অফ বিজনেস-এর তফসিল ১, ১৯৯৬ (এপ্রিল ২০১৭) পর্যন্ত সংশোধিত এর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত অংশের ১৬ নং অনুচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের মাধ্যমে ট্রানজিট বাণিজ্য’ শিরোনামে বাণিজ্যিক ট্রানজিট বিষয়ক কার্যক্রম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা আছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ কর্তৃক বিচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এজন্য এসব কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে সামগ্রিক সমন্বয়ের প্ৰয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।’
মাহবুবুল হক দাবি করেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য করণীয় সব কার্যক্রম অ্যালোকেশন অফ বিজনেস অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বয় করা হলে তা দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য বিকাশে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা/বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
একইভাবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরাও তাদের মতামত দেন। পরে সবার মতামতের ভিত্তিতে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে আমাদের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ আলোকে আঞ্চলিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে হবে। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মাথায় রেখে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেয়া দরকার। তাই বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য পরিবহন ও আঞ্চলিক যোগাযোগ সমন্বয়ের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই সম্পন্ন করবে। এক্ষেত্রে সামগ্রিক কার্যক্রমের বিষয়ে কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে তার সমাধানে সিদ্ধান্ত দেবে বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ‘ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কমিটি’। এর আলোকে দ্রুত আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কে পা রাখতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
সূত্র : নিউজ বাংলা