রুশো মাহমুদ »
নগরকে গড়ে তুলতে হবে আগামী দিনের জন্য। চট্টগ্রাম কি প্রস্তুত? সময় গড়িয়ে গেলে কিন্তু বিপদে পড়তে হবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামকে ঘিরে যে মেগা প্রজেক্টে তখন তার ভার এই নগরী বহন করতে পারবে না। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ঘাটতি রেখে নগরকে বিশ্বমানে নেয়া যাবে না।
দেশের প্রধানতম বন্দরে নানা উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, নগর থেকে অনতি দূরে তৈরি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ও পরিকল্পিত শিল্পনগর, হচ্ছে আউটার রিং রোড। তার কোল ঘেষে হবে আগামীর বন্দর বে টার্মিনাল। আউটার রিং রোড টানেল দিয়ে যুক্ত করছে ওপারের আনোয়ারাকে। টানেলের মাধ্যমে তৈরি হবে এক নতুন সম্ভাবনা। আমরা পাবো নতুন চট্টগ্রাম। মিরসরাই থেকে আউটার রিং রোডে যুক্ত হবে সুপার ডাইক। সাগরের পাশ ঘেষে ডাইক চলে যাবে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর মহেশখালী প্রান্তে যুক্ত থাকবে এই মেরিন ড্রাইভে।
চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইনের কাজও অনেকদূর এগিয়ে গেছে। চলছে ঢাকা চট্টগ্রাম বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই। সব মিলিয়ে ভাইব্রেন্ট চট্টগ্রামের পদধ্বনি শোনা যায়। আগামী দিনের নগর রূপান্তরে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এখনই তৈরি হতে হবে চট্টগ্রামকে।
একটি শহর বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে নদী ও খাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্ণফুলীর দুর্দশা যেকোনো উপায়ে দূর করা প্রয়োজন। শহরের খালগুলো প্রায় সবই ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। একটি শহর কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী মানুষের কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে, কিছুতেই সেটি হতে পারে না। আশার কথা হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেখানে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়নের কাজ হবে।
ব্যক্তি যেমন সমাজ বা দেশও তেমন, সুস্থ থাকতে গেলে বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন যথাযথ হতে হবে, তার ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো স্বাস্থ্যকর হতে হবে। একটি বিশ্বমানের শহরের জন্য আধুনিক সুয়্যারেজ সিস্টেম ও ভালো ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট অত্যাবশ্যক। ওয়াসা একটি সুয়্যারেজ প্রকল্প হতে নিয়েছে এবং কাজও শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটি বাসা থেকে পয়ঃবর্জ্য সরাসরি পাইপের মাধ্যমে চলে যাবে সুয়্যারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টে। ফলে শহরের কোন ভবনের নিচে আর সেপটিক ট্যাংক রাখার প্রয়োজন হবে না।
চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক ছিল। বলা হয়েছিল ফ্লাইওভারে মানুষ উঠবে না। কিন্তু মানুষ এখন উঠছে। কয়েকটি ফ্লাইওভার বেশ ভালো কাজ করছে। শহরের প্রবল যানজটপ্রবণ ষোলশহর ২ নম্বর এলাকা ও জিইসি মোড়ে গতি ফিরেছে। এখন হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। পুরোদমে কাজ চলছে। শহরের এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হবে যানবাহন। যানজট অনেকাংশেই কমে যাবে।
নগরের পরিসর বাড়াতে হবে সবদিকে। এখন প্রবণতা সীতাকু- ও হাটহাজারীমুখী। ওয়ান সিটি টু টাউন কনসেপ্টে টানেল হচ্ছে, কালুরঘাটে রেল কাম সড়ক নতুন সেতু হবে। শহরকে বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে আনোয়ারা, পটিয়া, বোয়ালখালী, সীতাকু- ও হাটহাজারী পর্যন্ত। এসব এলাকায় উপশহর গড়ে তুলে কমিউটার ট্রেন, মেট্রোরেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিটের মাধ্যমে মূল নগরের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে।
একটি শহরের উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিক নগর পরিকল্পনা বা গোটা শহরটিকে নিয়ে পরিকল্পনা বা পরিকল্পিত উপায়ে শহরটিকে গড়ে তোলা কিংবা কোথাও ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তোলার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আগামীর চট্টগ্রামের জন্য ভীষণ জরুরি। সিডিএ আওতাধীন এলাকাকে ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করার কথা ভাবা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় আবাসন সুবিধা, কর্মসংস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট, পার্ক ও খেলার মাঠসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার সমন্বয়ে প্রতিটি ব্লককে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলে মাস্টারপ্ল্যান মানার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।
নগর হচ্ছে বীজ থেকে বেড়ে ওঠা এক মহীরুহ। আধুনিকায়ন, সংস্কার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য অভিযোজন এসবই হচ্ছে নগর রসায়ন। প্রয়োজনবোধে নগরকে ওভারহোলিং করে নিতে হবে। ‘আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট’ বলে একটা কথা আছে। এই রি-ডেভেলপমেন্টের আলোকে নগর চট্টগ্রামকে নতুন রূপদান করা যেতে পারে। এটি একটি কঠিন কাজ তবে অসম্ভব নয়।
পৃথিবীতে কিছু শহর আছে নগরবিদগণ সেগুলোকে ‘গ্লোবাল সিটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিউইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি যার উদাহরণ। বাংলায় এই শহরগুলোকে বিশ্বনগরী বলা সঙ্গত। বিশ্বব্যাপী প্রভাব-প্রতিপত্তি ওসব শহরের। এই প্রভাব প্রধানত অর্থনৈতিক।
আজকের সিঙ্গাপুর একসময় আমাদের মতোই ছিল। যানজট আর জলাবদ্ধতায় অতিষ্ঠ ছিল সেখানকার জনজীবন। অথচ সিঙ্গাপুর আজ বিশ্বনগরের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমন কিছু সাধন করা আমাদের পক্ষেও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা। রাজনীতি যদি দেশের উন্নয়নকে সবার উপরে স্থান দেয় তাহলেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।