প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »
২৩ জুন ২০২১ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দলটি প্রতিষ্ঠার ২২ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। প্রতিষ্ঠাকালীন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অতি অল্পসময়ে স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশ এবছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আওয়ামী লীগের কা-ারি বঙ্গবন্ধু যেমনি স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমনি সভাপতি হিসেবে ৪০ বছর (১৯৮১ হতে) জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গঠন ও অগ্রগতির যে সূচনা হয় তা আজ পূূর্ণতা পেয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। যদিও স্বাধীনতার পর থেকে দেশের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয় তবুও বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে চলছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর থেকে দেশে সামরিক শাসনের যে অধ্যায়ের সূচনা হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে গণতন্ত্রের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। আর বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অত্যন্ত ব্যাপক। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে সম্মানের আসন লাভ করেছে। এটিও আওয়ামী লীগের বড় অর্জন আর এ অর্জন নিঃসন্দেহে এ দেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সদ্যস্বাধীন পাকিস্তানের বুক চিরে ঢাকার রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দলের আতœপ্রকাশ ঘটে। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও তারুণ্যের সম্মিলনে গঠিত দলটি অতিদ্রুত পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিশেষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত দলে তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২৩ শে জুন একটি বিশেষ স্মরণীয় একটি দিন। আলোচনায় আছে এদিন ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা পরাধীনতায় আবদ্ধ হয়। সেদিন ইংরেজ শাসন ও শোষণের যে সূত্রপাত হয়েছিল তা বহাল ছিল প্রায় দুইশত বছর।
ভারতের কংগ্রেস ১৩৬ বছরের রাজনৈতিক দল, সাম্প্রতিককালে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের অবস্থান কিছুটা ¤্রয়িমাণ বলে প্রতীয়মান হয়। দলটির যে ঐতিহ্য এবং বৃহৎ কাঠামো সেটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আরো অগ্রসর হওয়ার সুযোগ থাকলেও কার্যত তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
ফলে ভারতের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব থেকে এ দলটিকে বাইরে থাকতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ কার্যত অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। বারংবার ভাঙন দলটিকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। সর্বশেষ নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বে দলটি রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও এখন তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে।
কিন্তু বাংলাদেশে তাকালে ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৫ সালে এসে সাম্প্রদায়িক নাম পরিত্যাগ করে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। এরপর দলটির হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার বৈধ অধিকার লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালির বিরুদ্ধে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অতি অল্প সময়ের শাসনকালে দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। তাঁর নেতৃত্বে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটি থেকে একটি বিশ্বমানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ দেশ গঠনে দক্ষতার পরিচয় দেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির ইতিহাসে কালো দিন হয়ে আসে। জাতির পিতাকে পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর সামরিক শাসনের কবলে পতিত হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত সোনার বাংলাদেশ। সে অন্ধকার যুগ চলে দীর্ঘ সময় ধরে। এসময়ের প্রথম দিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতত্বের বলিষ্ঠ ভূমিকা দৃষ্টিগোচর হয় না।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যেন প্রাণ ফিরে পায়। ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে আওয়ামী লীগ। এসময়ে দেশের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়। মাঝে বিরতির পরে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সাফল্য, করোনা ভাইরাস মোকাবেলা, মধ্যআয়ের দেশে পৌঁছানো, তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া, পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থান, সবজি-মাছ রপ্তানিতে সাফল্য ও সমুদ্রজয়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ উন্নয়নে জনগণ এক বিপ্লব প্রত্যক্ষ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথাযথ নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রমাণিত হয়। ব্রিটিশ-ভারত, ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ধারাবাহিক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সাফল্য আনয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ভারতের গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে কংগ্রেস, পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো, বিলওয়াল ভাট্টির নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির সাফল্যধারা ম্রিয়মান হলেও বংশানুক্রমিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পরিবার অধিক কৃতিত্বের দাবিদার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান আওয়ামী লীগ অনেক বেশি শক্তিশালী ও সফল।
বর্তমান দক্ষ নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে, বিশ্ব দরবারে নিজের অবস্থান আরো জোরদার করবে বলে প্রত্যাশা রাখি। তবে এই নেতৃত্বের বিকল্প যেকোন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে যেতে পারে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা সকলের কর্তব্য।
লেখক : সাবেক ডিন
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়