হুমকিতে নিরাপত্তা
দীপন বিশ্বাস, কক্সবাজার »
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শন শুরু করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক এম-১৬ ও একে-৪৭ রাইফেলের মতো ভারী অস্ত্র। এতে ক্যাম্পজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতংক। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গত চার মাসে গোলাগুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ২৩ জন রোহিঙ্গা। আহত হয় দুই শতাধিক।
সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া জিরো পয়েন্টে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা গেছে দুজন। এরপরই অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের মহড়া শুরু হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের স্বাধিকার আদায় নয়, বরং আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সশস্ত্র মহড়া চালাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। জিরো পয়েন্ট ও ক্যাম্পে মজুত করছে গ্রেনেডসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র।
এর আগে তুমব্রু সীমান্তে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে গিয়ে নিহত হন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা। এছাড়া ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্তের জিরো পয়েন্টে রয়েছে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা ও গুদাম। ফলে কক্সবাজারের নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তবে জেলা পুলিশ বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবির পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে গত শনিবার রাতে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনিসহ তার সংগঠনের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে পোস্টার দেখা গেছে। বার্মিজ ভাষায় এসব পোস্টার লাগানো হয়। তবে কারা এসব পোস্টার লাগিয়েছে তার কোনো তথ্য জানাতে পারেনি কেউ।
আট নম্বর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাম্পে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। পোস্টারে থাকা নামগুলোর সবাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত। তারা একাধিক মামলার পলাতক আসামি। আমরা এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজছি। ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে আমাদের নজরদারি রয়েছে। গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।’
সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের স্বাধিকার আদায় নয় বরং মাদকব্যবসা এবং ক্যাম্পে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্যই সশস্ত্র মহড়া চালাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। জিরো পয়েন্ট ও ক্যাম্পে মজুত করছে গ্রেনেডসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র। পাশাপাশি সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো সুরক্ষিত থাকতে ব্যবহার করছে ওয়াকিটকি, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইম্যুসহ বিভিন্ন অ্যাপ। এসবের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে তারা। অনেকে আবার মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজে লাগাচ্ছে।
সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতে, স্বাধিকার আদায়ের কথা বললেও ‘আরসা’ মূলত মিয়ানমারের সৃষ্টি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এ সংগঠন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে প্রত্যাবাসনের দাবি বিশ্বজুড়ে জোরালো হওয়ায় তাকে হত্যা করে এ সংগঠনের জঙ্গিরা। এ ঘটনায় আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ জুনুনিকে প্রধান আসামি করে মামলাও হয়েছে।
বর্তমানে ক্যাম্পজুড়ে রাজত্ব করছে আরসা ও নবী হোসেন গ্রুপ। আর বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে তাদের উপগ্রুপ। মূলত ইয়াবা ব্যবসা ঘিরেই খুনের মহড়া চলে তাদের মাঝে। তাদের উগ্রতা ক্যাম্প ছাড়িয়ে প্রভাব ফেলছে স্থানীয়দের মাঝেও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, চার মাসে উখিয়ার একাধিক আশ্রয়শিবিরে আরসার সঙ্গে নবী হোসেন বাহিনীর একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২৩ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০ রোহিঙ্গা মাঝি এবং পাঁচজন আরসা সদস্য।
এদিকে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতংকের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করেছে এপিবিএন। ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ রয়েছে সতর্ক। আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।’
সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে পোস্টার
রোহিঙ্গাদের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, কথিত আরসা এবং মাদকব্যবসায়ী নবী হোসেন গ্রুপ মিয়ানমার সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের ভারী অস্ত্র, গ্রেনেড এবং বিনামূল্যে ইয়াবা সরবরাহ করে থাকে মিয়ানমার সরকার। নবী হোসেনের সঙ্গে এ গ্রুপের সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থানের কয়েকটি ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির সদ্য বদলি হওয়া অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির বলেন, ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শুধু রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, আমাদের জন্যও হুমকি। দেশে ৫০ ভাগের বেশি মাদক তাদের হাত ধরে ঢুকছে। আমরা তাদের ধরতে কাজ করছি।’
মুক্তিপণে ফিরল ৬ অপহৃত রোহিঙ্গা
গত কয়েকদিন আগে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ঘরে ফিরেছে অপহৃত ৬ রোহিঙ্গা। এ বিষয়ে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের এসব গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তারে একে অপরের ওপর হামলা, ক্যাম্পে খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। আমরা ৮ এপিবিএন পুলিশ সব সময় কঠোরভাবে এসব সন্ত্রাসীকে দমন করতে কাজ করছি। অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন ক্যাম্পে ‘ইনটেনসিভ প্যাট্রোলিং’ ও ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রেনেড উদ্ধার করতে গিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা হয়েছে।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’ তিনি বলেন, ‘নবীর ঘরে গ্রেনেড কীভাবে এসেছে, তা জানতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’