সুভাষ দে »
‘দরিদ্র দেশগুলিকে টিকা দিতে আগ্রহী নয় ধনী দেশগুলো’-এ কথাটি বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রুয়াসুস। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, মানবসভ্যতা যখন বিপর্যয়ের মুখে, প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র পথ বিশ্বের সকল দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা। এ প্রাপ্তিটিই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির কাছে করোনার টিকা এখন সোনার হরিণের মতো। শিল্পোন্নত কয়েকটি ধনী দেশ যারা টিকা উৎপাদন করছে এবং উৎপাদনে সামর্থ দেখিয়ে চলেছে, সে সব দেশ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাগে আনতে টিকা রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলি দুটি বলয়ে বিভক্ত, একদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত অন্যদিকে রয়েছে চীনÑরাশিয়া। চীনÑরাশিয়ার টিকা দেরিতে অনুমোদন পেয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার, এটিও পশ্চিমা দেশগুলির চাপের কারণে। ধনী দেশগুলি এ পর্যন্ত উৎপাদিত টিকার অর্ধেকের মতো নিয়েছে। অথচ এই দেশগুলিতে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মানুষ বাস করে। সম্প্রতি জি-৭ দেশগুলির নেতৃবৃন্দ এক সম্মেলনে আগামী বছরের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দেওযার কথা বলেছে। অথচ বিশ্বকে করোনার ঝুঁকিমুক্ত করতে ১ হাজার ২০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। টিকাকে বৈশ্বিক পণ্য হিসেবে গণ্য করার দাবি তুলেছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলি, এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও সমর্থন রয়েছে। অথচ জি-৭ সম্মেলনে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। যেখানে মহামারি মোকাবেলায় সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেখানে জি-৭ অর্থাৎ ধনী দেশগুলি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন চীন ও রাশিয়াসহ জিÑ২০ দেশগুলিকে এই প্রচেষ্টায় যুক্ত করার কথা বলেছেন। বরং দেখা যাচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে যা বিশ্ব টিকা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বের সকল দেশ যদি টিকা না পায়, সকল দেশ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে কোন দেশই নিরাপদ নয়, আমরা কি এ কথাটি বুঝতে অক্ষম যে মহামারির কোন সীমান্ত নেই।
বাংলাদেশ করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে এপ্রিলের ১ম সপ্তাহ থেকে, অক্সফোর্ড অ্যাস্টোজেনেকার টিকা দিয়ে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশকে ৩ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি করে বাংলাদেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এর সাথে, চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারও একটি পক্ষ। উপহার এবং ২ দফায় সরবরাহ হিসেবে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা আসে বাংলাদেশে। ভারতের করোনা পরিস্থিতি গুরুতর হলে ভারত সরকার বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলিতে টিকা সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ১৫ লাখ দ্বিতীয় ডোজ টিকা গ্রহীতা অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে সবদেশ অ্যাস্টেজেনেকার টিকা ব্যবহার করছে, সে সব দেশের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। একই সাথে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা পেতে আলোচনা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০ লাখ অক্সফোর্ড ‘অ্যাস্টেজেনেকার টিকা দিতে সম্মত হয় এবং তা জুলাই মাসে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বিত টিকা প্রতিষ্ঠান কোভ্যাক্সের মাধ্যমে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ অনুসারে ৫ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা তবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। এই প্রাপ্তি নির্ভর করে ধনী দেশগুলি কখন কোভ্যাক্সকে টিকা সরবরাহ করে তার ওপর। চীনের টিকা সিনোম্যাক্স, সিনোভ্যাক এবং রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক ভি এর অনুমোদন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দেরী করায় এই দুটি দেশের সাথে টিকা ক্রয় চুক্তি নিয়ে আলোচনা কিছুটা দেরিতে শুরু করতে হয়। চীন ও রাশিয়ার সাথে টিকা ক্রয় এবং প্রয়োজনে বাংলাদেশে এই দুটি দেশের সাথে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের ব্যাপারে আলোচনা অব্যাহত আছে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে প্রথমে চুক্তি হওয়ায় চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকে। এদিকে ‘কোয়ার্ড’ ইস্যুটি সামনে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ভারতের সমন্বয়ে ‘কোয়াড’ জোটে যোগদান না করতে চীন বাংলাদেশকে সতর্ক করে দেয় যদিও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই জোটে যোগদানের আমন্ত্রণ পায়নি।
টিকার যে দুটি প্ল্যাটফর্ম সেই দুটি বলয়ের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। কেননা বাংলাদেশে চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভারত, রাশিয়া ও চীন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ঝামেলায় পড়েছে, টিকা নিয়ে যে বৈশ্বিক রাজনীতি, তার মধ্যে বাংলাদেশ জড়াতে না চাইলেও এই বৈশ্বিক কূটনীতি থেকে দূরে থাকতে পারছে না।
দ্রুত টিকা পেতে চীনের নেতৃত্বে ‘ইমার্জেন্সি কভিড ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর সাউথ এশিয়া’ নামে একটি প্ল্যাটকর্মে যুক্ত হয় বাংলাদেশ, অন্য ৪টি দেশ হচ্ছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তান।
চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা পেতে বাংলাদেশের আলোচনা চলছে। উন্নত দেশগুলির টিকা পেতেও যোগাযোগ অব্যাহত আছে কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ভাষায় সবাই মুলো ঝুলিয়ে দিচ্ছে, এগোচ্ছে না। ইতিমধ্যে চীনের ১১ লাখ টিকা উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে এবং তা দেয়ার কাজ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ২৫ লাখ মডার্নার টিকা দেবে বলেছে, ফাইজার, এসেছে ১ লাখ ডোজ। আমরা মনে করি টিকা নিয়ে যে বৈশ্বিক রাজনীতি, চাপ ও কৌশলের রাজনীতি চলছে ,তা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তিনি দেশে ভ্যাকসিন তৈরিতে গবেষণা ও ইনস্টিটিউট স্থাপনের কথা বলেন। আমাদের দেশে বিগত শতকের পঞ্চাশÑষাট দশকে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (আইপিএইচ) ৬টি রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদিত হতো। সেই ভ্যাকসিন তৈরির ইনস্টিটিউটও আছে। আমরা মনে করি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিকও ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। চীন ও রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে করোনার টিকা উৎপাদন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত। এটা তো এখন প্রমাণিত হয়েছে, টিকা ছাড়া করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনার অন্য কোন পন্থা সামনে নেই।
ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্স এর মাধ্যমে টিকা পেতে আমাদের বহুমাত্রিক ও দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ভারতের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে চুক্তি মোতাবেক টিকা সরবরাহ করতে পারে। যেভাবে ভারত টিকা সরবরাহে আমাদের ঝুলিয়ে রাখলো তা দুঃখজনক, এতে নিকট প্রতিবেশির বিপদের সময়ে স্বার্থ দেখার পরিবর্তে বৈশ্বিক কূটনীতি বেশি কাজ করেছে। চীন ও রাশিয়ার উচিত গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রতি টিকা সরবরাহে উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।
এদিকে ইউরোপÑআমেরিকা এবং চীনÑরাশিয়ার করোনা সংক্রমণ কমেছে কিন্তু এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে সংক্রমণ বেড়েছে অথচ এই দেশগুলি টিকা তেমন পাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রুয়াসুস বলেছেন, ‘ধনী দেশের সঙ্গে দরিদ্র দেশের পার্থক্য হলো টিকা থাকা অথবা না থাকা, টিকার এ বৈষম্য বৈশ্বিক অন্যায়, অবিচার ও অসমতাকে প্রকাশ করেছে’। উন্নয়নশীল দেশগুলি টিকা ব্যবহার করতে পারবে কিনা, এ আশঙ্কায় টিকা সরবরাহ না করা এক ধরণের ঔপনিবেশিক মানসিকতাÑ বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি সেবাবিষয়ক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ মাইক রায়ান। ডব্লিউ এইচ ও প্রধান আফ্রিকায় গত সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে মর্মে এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করে বলেন, বিশ্ব ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধের পর কোভ্যাক্স ও গ্যাভিতে টিকা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে বলেও তিনি জানান।
মানবসভ্যতা ও বিশ্বের মানুষ এখন ভয়াবহ বিপদের মুখে। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, লাখ লাখ সংক্রমিত হচ্ছে করোনা মহামারিতে। বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে উন্নত ধনী দেশগুলি টিকা সরবরাহে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মানব বিপর্যয় এড়ানো যাবে না। নোবেল বিজয়ী লেখকÑবুদ্ধিজীবী, এবং দেশে দেশে নাগরিক সমাজের কাজ হবে মানবসভ্যতা বাঁচাতে ধনী দেশগুলোর ওপর টিকা সরবরাহে মানবিক দায় চাপানো। বিশ্বের সকল দেশের, সকল মানবের অবদানে বিশ্ব সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে। ধনী দেশগুলি শতাব্দীব্যাপী ঔপনিবেশিক নিষ্ঠুর শোষণে এশিয়াÑআফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সম্পদ শোষণ করে তাদের ধনস্ফীতি ও সম্পদস্ফীতি ঘটিয়েছে, এখন তাদের উচিত এসব দেশের কিঞ্চিৎ ঋণ পরিশোধ করা। বৈশ্বিক কূটনীতি পরিহার করে মানবিকতা ও জীবন বাঁচানোর কাজটিকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নত দেশগুলি এগিয়ে আসবেÑবিশ্বের মানুষ সে আর্তিই জানাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক