এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চট্টগ্রাম

  • নগর সম্প্রসারণে শহরতলীর সাথে যোগাযোগে সহায়ক হতে পারে মেট্রো রেল

  • পটিয়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী, সীতাকু-কে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন

ভূঁইয়া নজরুল »

চট্টগ্রামের প্রথম ফ্লাইওভার চালু হয় বহদ্দারহাটে। যার নামকরণ করা হয় এম.এ.মান্নান ফ্লাইওভার। এই উড়ালপথের নির্মাণের শুরুটা সুখকর ছিল না। একটি দুর্ঘটনায় নির্মাণাধীন প্রথম ফ্লাইওভার প্রকল্পকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। যদিও পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোনভাবে কাজটা শেষ করা হয়। নির্মাণশৈলী ও মানের দিক থেকে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে ইংরেজি ওয়াই আকৃতির যে র‌্যামটি চান্দগাঁও বাস টার্মিনালের দিকে নেমে গেছে সেটা কোনভাবেই বাস্তবসম্মত হয়নি। বলা যায় গোজামিলের সংযুক্তি। দুর্ঘটনার ঝুঁকি এখানে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। ভবিষ্যতে এই ফ্লাইওভার রাখা না রাখার প্রশ্ন আসতে পারে। মূলত এই তুলনাগুলো আমরা করতে পারছি পরবর্তীতে নির্মিত আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার হওয়ার কারণে।

এই ফ্লাইওভারের কল্যাণে এখন লালখান বাজার থেকে বায়েজিদ হয়ে বাইপাস রোড দিয়ে দ্রুত ফৌজদারহাট চলে যাওয়া যায় এবং সেখান থেকে সাগর পাড়ের আউটার রিং রোড দিয়ে পতেঙ্গা চলে যাওয়া যায়। এখন যদি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হয় তাহলে পতেঙ্গা পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। এই রোডের শেষ প্রান্তে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ হচ্ছে বলে তা দিয়ে কক্সবাজারমুখী যাতায়াতও সহজ হলো। আবার শাহ আমানত সেতু থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর পাড় দিয়ে চার লেনের একটি রোড নির্মিত হচ্ছে এবং সেই রোডের সাথে কয়েকটি ফিডার রোড তৈরি করা গেলে নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বায়েজীদ বাইপাস রোডের সাথে জাকির হোসেন রোডের সংযোগ করা গেলে মধ্যবর্তী এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। আর এসব রোডের যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড  এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে?

লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সল্টগোলা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত পিলার বসানোর কাজ শেষ এবং অর্ধেক এলাকায় গার্ডারও বসানো হয়েছে। এখন কাজ শুরু হবে সল্টগোলা রেলক্রসিং থেকে কাস্টমস পর্যন্ত এলাকায়।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন সিডিএ’র নির্বাহি প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। তিনি আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার (৫ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ) প্রকল্পের পরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেন,‘লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েনির্মাণ শেষে নগরবাসী শাহ আমানত সেতু থেকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া পতেঙ্গা পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবে। কোনো ধরনের ট্রাফিক সিগন্যালে পড়তে হবে না।‘

তিনি আরো বলেন, যেহেতু বিদ্যমান আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে জমিয়তুল ফালাহ গেটের সামনের অংশ থেকে দুটো উইং দুই দিক দিয়ে চলে যাবে টাইগারপাস পর্যন্ত। সেখান থেকে দুটি উইং এক হয়ে দেওয়ানহাট ওভারপাসের উপর দিয়ে পতেঙ্গার দিকে চলে যাবে। অপরপ্রান্ত বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত থাকছে এবং বর্তমানে সড়ক ও জনপথের ৫ কিলোমিটার রোডের কারণে সেতু পর্যন্ত (প্রায় ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ) মানুষ নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারবে।

শহরতলীর সঙ্গে যোগাযোগে প্রয়োজন মেট্রো রেল

১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যান ও ২০০৮ সালের ড্যাপে হাটহাজারী, আনোয়ারাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে গ্রোথ সেন্টার গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছিল। নগরে জনসংখ্যার চাপ সামলাতে এবং শহরকে পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ করতে এসব গ্রোথ সেন্টারের গুরুত্ব রয়েছে। এবিষয়ে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, শহরের আশপাশের হাটহাজারী, সীতাকু-, আনোয়ারা ও পটিয়াকে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এতোদিন তা করা হয়নি। এখন চট্টগ্রামের আশপাশে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে এই নগরের ওপর মানুষের চাপ বাড়বে। তাই এখনই আশপাশের এলাকাগুলোকে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সবার আগে কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে। কমিউটার ট্রেন এবং মেট্রো রেলের মাধ্যমে এসব এলাকা সংযুক্ত হতে পারে।

একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, গ্রোথ সেন্টারগুলো সচল করা গেলে নগরে মানুষের চাপ কমবে এবং শহরটি আরো গতি পাবে। এজন্য মেট্রোরেলের রুট করা যায়।

প্রয়োজন বিমানবন্দরের সম্প্রসারণও

চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে সরকারের মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখন বিদেশি বিনোয়োগ যেমন বাড়বে আকাশপথে যোগাযোগও বাড়বে। কিন্তু সেই অনুযায়ী বিমান বন্দর সম্প্রসারণ হয়নি। এবিষয়ে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন প্রয়োজন। একইসাথে বিমানবন্দর থেকে যাতে মানুষ সহজে পরিবহন পায় সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। বর্তমানে ঢাকায় টার্মিনাল-৩ যেটা হচ্ছে সেটিতে কিন্তু মেট্রো রেলের সংযোগ থাকছে।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার ফরহাদ হোসেন খান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে বাড়ানো হচ্ছে। একইসাথে নতুন টার্মিনাল ভবন তৈরির কাজও রয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের কাজ শেষ হবে।’

হচ্ছে নতুন মাস্টারপ্ল্যান

ভিশন ২০৪১ কে টার্গেট করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) শুরু করেছে নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ। এই মাস্টারপ্ল্যানে কী থাকছে জানতে চাইলে মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ‘আমরা এবার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করবো। সেই অ্যাকশন প্ল্যানের আলোকে নগরীর অনেক ছোটো ছোটো আয়তনের এলাকাগুলোর জন্য বিশেষ প্ল্যান করবো। একইসাথে গ্রোথ সেন্টারগুলোকে সচল করতে নির্দেশনা দেয়া হবে।’

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর কোথায় আবাসন, কোথায় শিল্পজোন হবে সেই নির্দেশনাও থাকবে মাস্টারপ্ল্যানে। একইসাথে যেসব শিল্প কারখানাগুলো জনবান্ধব সেগুলো শহরতলীর পাশে এবং ভারী শিল্পকারখানাগুলোকে শহরের বাইরে গিয়ে স্থাপন করতে বলা হবে মাস্টারপ্ল্যানে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে নির্মাণ হচ্ছে বে টার্মিনাল। আগামীর বন্দর খ্যাত বে টার্মিনালচালু হলে বাড়বে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার। অপরদিকে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মিত হচ্ছে বলে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সহজ হবে।

একইসাথে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়াও রয়েছে আরো ২৫টি প্রকল্প। মিরসরাইয়ে ২২ হাজার একর জায়গায় গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। সেখানে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। আর এসব উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হবে চট্টগ্রাম মহানগর।