এ টি এম মোসলেহ্ উদ্দিন জাবেদ »
আমাদের দেশের প্রধান সম্পদ হল মানব সম্পদ। উন্নয়ন মূলত মানুষ কেন্দ্রিক, তাই মানব সম্পদ হল উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আমরা যে আজ নি¤œ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, তা আমাদের কর্মক্ষম মানব সম্পদেরই অবদান। ‘ডেমোগ্রাফিক বোনাস’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। যার আভিধানিক অর্থ হল- জনসংখ্যার বয়স ভিত্তিক সুবিধা। সিআইএ-দ্যা ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক এর মতে; যখন কোন দেশের কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি থাকে তখন সেই দেশ ডেমোগ্রাফিক বোনাসে প্রবেশ করে। উল্লেখ যে, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক বোনাসে প্রবেশ করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগই ২০ বছরের নিচে। জনগণের বয়স (মিডিয়ান এজ) এখন প্রায় ২৫.৪ বছর। অর্থাৎ জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স পঁচিশের নিচে। ডেমোগ্রাফিক বোনাসের সর্বোচ্চ সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আমরা বর্তমানে অবস্থান করছি। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৩ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি লোক কর্মক্ষম বয়সসীমায় অবস্থান করছে। এ অবস্থা আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অর্থনীতিবিদ ও জনসংখ্যা বিশারদদের মতে, প্রতি ৫০ থেকে ৬০ বছর পর পর একটি দেশ এই অবস্থায় প্রবেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এই অবস্থা এসেছে প্রায় দেড়শ বছর পরে। এই সুবিধার সঠিক ব্যবহারের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন।
বর্তমানে আমরা নি¤œ মধ্য আয়ের দেশ হয়েছি। ডেমোগ্রাফিক বোনাসের উপর নির্ভর করে আমরা হয়ত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবো। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম সে অর্জন ধরে রাখতে না পারলে, সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়বে। যেমনটা হয়েছে নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে। যেহেতু দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে, তাই উন্নয়নের স্বার্থে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির জন্য সময় উপযোগী ও সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, পাশাপাশি সুশাসনটাও গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনের উন্নয়ন ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন।
যদিও আজ আমরা ডেমোগ্রাফিক বোনাসে অবস্থান করছি। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- আমাদের এই কর্মক্ষম জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী-বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২৬ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মহীন। অপ্রিয় হলেও সত্য, তাদের এই অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী। কারণ, এই কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তরের ব্যবস্থা আমরা করে দিতে পারিনি। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বেড়েছে, এটি ভাল দিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সবাইকে যেন গণহারে গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। উন্নত বিশ্বে এ ধরণের কোন প্রচলন নেই। অথচ এখানে মেধাবী এবং মেধাহীন প্রায় সকলেই একই পথে চলছে। এই জায়গাটিতে রাষ্ট্রকে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা হতে হবে বাস্তবমুখী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে আগামী ২০ বছরে শ্রমখাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। স্বল্পদক্ষ শ্রমবাজারের ভিত্তিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভিত্তি গড়ে উঠেছে বলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারিগরি উৎকর্ষ ও রূপান্তর থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে। এই বিশাল শ্রমবাজারের কি কি ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হবে, তা নিয়ে এখনই গবেষণা ও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কর্মমুখি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়ে আমাদের জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শর্তই হলো প্রযুক্তিগত জ্ঞান। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ আউটপুট পেতে ভালভাবে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারলেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ হবে উন্নত ও স্বনির্ভর।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা ভাল দিক হল- বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা। আন্তর্জাতিক মহলে এই ব্যবস্থার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। যুগের প্রয়োজনে এটাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের পররর্তীদের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। তারা বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ও সার্টিফিকেট সমৃদ্ধ হয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য যে, যারা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করেছেন অর্থাৎ আমাদের যে সকল কর্মীরা বিদেশে কাজ করতে যান তাদের বেশির ভাগেরই কোন প্রশিক্ষণ নেই। ফলে তাদেরকে সেখানে অড জব করতে হচ্ছে এবং বেতনও পাচ্ছেন কম। তারা যদি প্রশিক্ষিত হয়ে বিদেশে যেতে পারতেন, তাহলে ভাল কাজ করতেন এবং আয়ও বেশি করতে পারতেন।
পরবর্তীতে মেধাবীরা উচ্চ শিক্ষার দিকে অগ্রসর হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় ইন্টার্নি ও মাঠ পর্যায়ে এসাইনমেন্ট তৈরিকে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। কোন কোন বিষয়ে কতজন গ্র্যাজুয়েট প্রয়োজন তা পরিকল্পনা করে কলেজÑবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে সেভাবে বিন্যস্ত করতে হবে। তবে কাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এই জন্য মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মপরিবেশও উন্নত ও আধুনিক করা প্রয়োজন। মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়Ñ৭০% দক্ষতা আসে কাজের মধ্যদিয়ে, ২০% দক্ষতা আসে মিথস্ক্রিয়ার (ইন্টারেকশন) মধ্যদিয়ে ও ১০% দক্ষতা আসে প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল সাপোর্ট জোরদার করা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কেননা ভবিষ্যতে দক্ষ মানবসম্পদই প্রতিষ্ঠানের অধিক উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে অধিক ভূমিকা পালন করবে।
মানব সম্পদকে কখনোই পণ্য বা কমোডিটি হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তাদেরকে সৃজনশীল ও সামাজিক জীব হিসেবে দেখতে হবে। ফ্রান্স ও জার্মানির এই অ্যাপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে সফল হয়েছে। পরে ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সেই দৃষ্টিভঙ্গির স্বীকৃতি দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা হল, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাহিদা থাকায় তাদের দক্ষ মানব সম্পদ বা মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা উন্নয়নশীল দেশের তকমা ও এর চক্র হতে বের হয়ে আসতে পারছে না। যেহেতু এইভাবে উন্নত দেশগুলি আরও উপকৃত হচ্ছে, তাই সেই সব দেশের উচিত তৃতীয় বিশ্বের এইসব দেশে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেয়া। বিভিন্ন কর্মমুখী ও যুগোপযোগী ইনস্টিটিউট বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের মত এইসব জনবহুল দেশে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি হলে তা উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সকল দেশের জন্যই কল্যাণকর হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক