৮ উপদেষ্টার ‘দুর্নীতির’ প্রমাণ থাকার দাবি সাবেক সচিবের; নাকচ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের

সুপ্রভাত ডেস্ক »

অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতির’ প্রমাণ নিজের কাছে থাকার দাবি করেছেন সাবেক সচিব ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার। তবে তা ‘ভিত্তিহীন’ বলে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ।

গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও উপদেষ্টাদের দুর্নীতির প্রমাণ থাকার দাবি করে আবদুস সাত্তার অভিযোগ করেন, “উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।”

তবে অফিসার্স ক্লাবের এই সাধারণ সম্পাদক এসব উপদেষ্টার নাম বলেননি।

রাজধানী ঢাকায় শুক্রবার বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছিলেন তিনি।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। সারাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সমন্বয়ক আবদুস সাত্তার এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

এদিকে উপদেষ্টাদের দুর্নীতি নিয়ে আবদুস সাত্তারের বক্তব্যকে ভিত্তিহীন অভিযোগ হিসেবে তুলে ধরে তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ।

শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা এই অভিযোগগুলো দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। প্রমাণ উপস্থাপন বা ব্যক্তিদের শনাক্ত না করে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং জনআস্থার জন্য ক্ষতিকর।”

বিবৃতিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “আমাদের প্রশাসন স্বচ্ছতা, সততা এবং জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদি জনাব আবদুস সাত্তারের কাছে কোনো অসদাচরণের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকে, আমরা তাকে যথাযথ আইনগত ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তা দ্রুত জমা দেওয়ার আহ্বান জানাই।

“যতক্ষণ না এমন প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমরা সকল অংশীজনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জনপরিসরের আলোচনা অনুমান নয়, বরং তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া সমীচীন।”

কী অভিযোগ আবদুস সাত্তারের

অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা সাত্তার বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের ‘দুর্নীতির’ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও প্রমাণ আছে। উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।”

বর্তমান সরকারের সময়কার ‘দুর্নীতি’ আগের আওযামী লীগ সরকারের সময়কেও ছাপিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে তিনি দুটি উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন, “আমি এখানে বক্তব্যের শুরুতে দুটি ঘটনা বলবো। একজন সহকারী কমিশনার (ভূমি); তিনি একটি স্কুলের জমির নামজারির ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন। আরেকটি ঘটনা, ঢাকার আশেপাশেরই। একজন ইউএনও একটি কারখানার ‘লে আউট’ পাস করতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন।”

তার ভাষ্য, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই অভ্যুথানের পর দুর্নীতির পথে আর সবাই হাঁটবে না। এটাই তো আশা ছিল সবার। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, গত এক বছরে অতীতের দুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে।”

দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসার পর ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ করে সাবেক এই সচিব বলেন, “আমার প্রশ্ন যে উপদেষ্টার পিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা মিডিয়াতে এসেছে। তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হল না? এই সরকার নিয়ে একটা কথা বাইরে প্রচলন আছে যে এই সরকার ‘বৈদেশিক সরকার’। এই সরকার ‘গ্রামীণ ব্যাংকের সরকার’, ‘চিটাগং সমিতির সরকার’।”

প্রধান উপদেষ্টা জেনেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমার একটাই অনুরোধ ইউনুস সাহেবের প্রতি আমি তার ভক্ত। তার সাফল্য কামনা করি। কী হচ্ছে ইউনুস সাহেব জানেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

“হতাশার কথা বললাম এই কারণে, এই জায়গা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমি খুবই হতাশ।”

সেমিনারে আবদুস সাত্তার প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের যোগ্যতা নিয়েও।

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মত একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন?’ এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, উনি কে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নূরজাহান বেগমকে দিয়ে দেওয়া হল। এখন যা হওয়ার তাই হচ্ছে।”

একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন ‘অনভিজ্ঞ উপদেষ্টাকে’ দিয়ে পরিচালনা করার বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

রাজধানীর ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে ‘জুলাই গণঅভ্যুথানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন সংস্কার’ শিরোনামে সেমিনারে মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।

অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক শাফিউল ইসলাম।

আমলাদের অনেকেই দলীয় অফিস ভিড় করে বিভিন্ন তদবির করাতে চান দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার বলেন, “আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। গত বছর ৫ অগাস্টের পর ওই অফিসে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ভিড় করছেন।

“আমার বস তারেক রহমান (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) একদিন আমাকে বললেন, “‘এরা এখানে কী জন্য আসে?’ আমি তখন মিথ্যা বলেছি। আমি বলেছি, এরা সবাই বঞ্চিত, হাসিনার আমলে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তারেক রহমান তখন বলেছেন, উনাদের এখানে আসতে নিষেধ করেন, দলীয় অফিসে ইন-সার্ভিস কর্মকর্তারা আসা ভালো লক্ষণ নয়।

“আমি সবাইকে দলীয় অফিসে আসতে মানা করেছি। কোনো সমস্যা থাকলে অফিসার্স ক্লাবে আসেন। ইন সার্ভিসে থেকে দলীয় হওয়ার তো দরকার নাই। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা নিজেদের তৈরি করেন- না হয় বিপদ আছে। জনপ্রশাসনে কর্মরতদের কোনো দলীয় বৃত্তে না থেকে কাজ করতে হবে। বিগত সময়ে যারা দুর্নীতি করেছেন, আমাদের সহকর্মীরা। তাদের কেউ কেউ এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ এখন কারাগারে। এসব মাথায় রেখে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে কাজ করতে হবে।”

ইউনূস সরকারের প্রশংসাও করেন সাবেক এই সচিব। বলেন, “এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দুর্নীতির বিচার শুরু হয়েছে। দ্রুত গতিতে বিচার হচ্ছে। জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হয়েছে। সুখের কথা হল এক বছরে এই সরকার অন্যান্য খাতে যা করেছে, তা প্রশংসনীয় অর্জনের দাবি রাখে।

“গোটা দেশের মানুষের মধ্যে, জাতির মধ্যে স্বস্তির যে বার্তা সেটা হচ্ছে নির্বাচন। ইউনূসের প্রতি আমি সাধুবাদ জানাই, অভিনন্দন জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই। উনি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন।”

নির্বাচনে দলীয় পক্ষপাতিত্ব না করার আহ্বান জানিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এই নির্বাচন নিয়ে আমার কথা আছে। আপনাদেরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। বিভিন্ন দল, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আপনারা যদি এইবার নির্বাচনে কোনো পক্ষপাতিত্ব করেন আপনাদের রেহাই নাই।

“২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডিসি, ইউএনও ও এসপিরা ছিল। তাদের কেউ কেউ এখন চাকরিতে নাই। কেউ জেলখানায়, কেউ চাকরিচ্যুত, কেউ ওএসডিতে আছেন। সামগ্রিকভাবে সবাই যে খারাপ ছিল তা নয়। ভালো অফিসারও ছিল। কিন্তু অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছেন। আমাদের সবাইকে মিলে একটা ধারণা তৈরি করতে হবে, আমাদের মত অফিসাররাই তো ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও নির্বাচন করেছি। বিদেশিরাও স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমাদের জনগণকে এই ধারণাটা দিতে হবে। আমরা তাদের জন্যই কাজ করি।”

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সরকারি কর্মকমিশনের সচিব সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া।

আরও বক্তব্য দেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, নিহত আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী, নিহত মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী এবং নিহত শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দ্বীপ্তি।