উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী »
বাঁশখালী উপকূলবাসীর প্রাণ রক্ষায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার নবনির্মিত স্থায়ী বেড়িবাঁধ জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই ভেঙে যাচ্ছে। খানখানাবাদ উপকূলের কদম রসুল গ্রামে ১০ দিন ধরে বিশালকার বেড়িবাঁধ জোয়ার-ভাটার ¯্রােতে তলিয়ে যাওয়ায় এলাকাবাসী চরম আতংকে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র সংশ্লিষ্টরা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তারও বিশালকার ভাঙন দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার জিও ব্যাগ (বালু ভর্তি) বরাদ্দ করলেও কিছুতেই ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন বেড়িবাঁধে দুর্নীতি ও নকশা ক্রটির কারণেই স্থায়ী বেড়িবাঁধ অস্থায়ী বেড়িবাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। অবশ্য পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেন, স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর সাঙ্গু নদীর ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পানির গতিপথ পাল্টে বঙ্গোপসাগর অংশে বিশাল বালুচর সৃষ্টি হয়েছে। ওই বালু চরে পানি প্রবাহের গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উল্টো বেড়িবাঁধে আঘাত করায় ভেঙে যাচ্ছে।
বাঁশখালীর খানখানাবাদ কদম রসুল গ্রামের গিয়ে দেখা গেছে, উপকূলবাসীর মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। ওই গ্রামের বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর মোহনায় প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা বেড়িবাঁধে তলিয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের পাশে পানি প্রবাহ হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ ফুট গভীর তলদেশ হয়ে। অথচ তার বিপরীত অংশে জেগে ওঠেছে বঙ্গোপসাগরে আনুমানিক ২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র বালু চর। প্রতিদিন নতুন এলাকায় ফাটল ধরছে। কিছু শ্রমিককে দেখা গেছে ভাঙন ঠেকাতে পাউবো’র বরাদ্দ জিও ব্যাগ বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশে দিচ্ছে। শ্রমিকরা দাবি করেন, এ জিও ব্যাগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাগরের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে এক শ্রেণির মানুষ লুটপাট করার পরিণতিই অল্প সময়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধে ফাটল ধরেছে এবং ভাঙছে।
পাউবো সূত্র জানায়, বাঁশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ২০১৫ সালের ১৯ মে একনেকে পাস হয়। ব্যয় ধরা হয় ২৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। দফায় দফায় প্রকল্পটির সময় ও ব্যয় বেড়েছিল। সর্বশেষ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় ধরা হয়েছিল এবং ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ভাঙন রোধ ও পুনরাকৃতিকরণ, ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ এবং ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ করার কথা ছিল।
খানখানাবাদ ও ছনুয়া এলাকার বাসিন্দা আলী নবী, আব্দুল কাদের, রোখন উদ্দিনসহ অনেকে বলেন, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে দুর্নীতি করেছেন। বেড়িবাঁধ রক্ষায় ঢালু বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা লাগানো হয়নি। ব্লক নির্মাণে নি¤œমানের পাথর, ইট, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহার করায় কাজ বুঝিয়ে দেয়ার আগেই অধিকাংশ সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধ জুড়ে ভাঙা সিসি ব্লক ও নি¤œমানের বেড়িবাঁধ দৃশ্যমান হলেও পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোন নজর নেই।
বেড়িবাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হাসান এন্ড ব্রাদাসের দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক রুদ্র শাহরিয়ার বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোন ধরণের অনিয়ম করা হয়নি। সমুদ্রের জেগে ওঠা চর খনন না হলে এই বেড়িবাঁধ রক্ষা করা কঠিন হবে। এটা নকশার ক্রটি। আমাদের কোন গাফিলতি নয়।
খানখানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, খানখানাবাদে ভয়ংকরভাবে বেড়িবাঁধ ভাঙছে। এখানে পাউবো’র বরাদ্দ জিও ব্যাগ দিয়েও বেড়িবাঁধ রক্ষা করা যাচ্ছে না। জেগে ওঠা বালুচর খনন করলেই খানখানাবাদবাসী বাঁচবে। নইলে বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে পুরো বেড়িবাঁধ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন, খানখানাবাদের কদম রসুল গ্রামে বেড়িবাঁধ ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখেছি। সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানিয়েছি। জেগে ওঠা সমুদ্রের বালু চর খননের বিষয়টি দেখার অনুরোধ করেছি।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ-জামান খান বলেন, বাঁশখালী উপকূলের খানখানাবাদে নব নির্মিত বেড়িবাঁধের পাশে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা বালু চরে সাঙ্গু নদীর পানি গতিপ্রবাহের কারণে বেড়িবাঁধ ভাঙছে। বেশ কয়েকবার জরিপ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। সমুদ্রচর ড্রেজিং হলেই বেড়িবাঁধ রক্ষা হবে। ভাঙন রোধে পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ বরাদ্দ দিয়েছি।