সুপ্রভাত ডেস্ক :
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ চার মাস অন্তর রক্তদান করতে পারেন। তার মানে বছরে কেউ রক্ত দিতে পারবেন তিন বার। তাহলে একজন মানুষ যদি প্রাপ্ত বয়স্ক, অর্থাৎ ১৮ বছর হওয়ার পর থেকে রক্তদান শুরু করেন এবং ৮০ বছর পর্যন্ত রক্ত দেন, তাহলে গোটা জীবনে তিনি মোট রক্ত দিতে পারবেন ১৮৬ বার।
তবে এখন যদি বলি পৃথিবীতে এমন একজন ব্যক্তি আছেন। যিনি তার গোটা জীবন ১১৭৩ বার রক্তদান করেছেন। ব্যাপারটা শুনে একটু খটকা লাগছে, তাই না? তবে চলুন আজ এমনই এক মহৎ প্রাণ ব্যক্তির গল্প জানবো, যিনি তার গোটা জীবনে ১১৭৩ বার রক্তদান করে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ শিশুর জীবন বাঁচিয়েছেন।
ভদ্রলোকের নাম জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসন। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ায়। জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসনের বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন তার একটি মেজর অপারেশন হয়। তাকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ছিল প্রায় ১৩ লিটার রক্তের।
এতো পরিমাণ রক্ত জোগাড় করা আর চাট্টিখানি কথা নয়। তাই শুরু হলো শহর জুড়ে মাইকিং এবং অবশেষে বহু কষ্টে তার বাবা ছেলেকে বাঁচানোর জন্যে রক্তের জোগাড় করতে সক্ষম হন। অপারেশনের তিন মাস পর, সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন বাকি জীবন, অর্থাৎ যতদিন বাঁচবেন রক্ত দান করবেন।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম রক্তদান শুরু করেন। তবে এর কিছুদিন পরেই আশ্চর্যজনকভাবে একটি ব্যাপার ঘটে। এক অদ্ভুদ ধরণের শক্তিশালী এন্টিবডি আবিস্কৃত হয় ক্রিস্টোফার হ্যারিসনের শরীরে যা ডি আরএইচ ক্রপ অ্যান্টিজেন এর প্রতিরোধী। বিজ্ঞানীরা তার রক্ত থেকে নবজাতক শিশুদের কমন একটি রোগ। রেসাস ডিজিজ এর প্রতিষেধক তৈরি করতে সক্ষম হন।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ১০০ জনের ১৭ জন নারীর ক্ষেত্রেই গর্ভাস্থায় রিসাস নেগেটিভ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।আর এসব ক্ষেত্রে অ্যান্টি ডি ইনজেকশনই একমাত্র ভরসা। এই ব্যাপারগুলো জানার পর, ক্রিস্টোফার হ্যারিসন সরাসরি কাউকে রক্ত দেয়ার পরিবর্তে রক্ত দিতেন ওই বিশেষ ধরনের অ্যান্টি ডি ইনজেকশন তৈরির উদ্দেশ্যে, যাতে করে আরো অধিক সংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। প্রতি তিন সপ্তাহে একবার রক্ত দিতেন তিনি।
আর কিছুদিন পর পর এভাবে রক্ত দিতে পারতেন তার কারণ হলো তিনি সরাসরি রক্ত নয়, প্রদান করতেন রক্তের প্লাজমা। ২০১১ সালের মে মাসে ১০০০তম বার রক্তদান সম্পন্ন হয় মহান এই মানুষটির। তার দান করা রক্তের সাহায্যে এখন পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় ২০ লাখ নবজাতক শিশুর প্রাণ বাঁচানো হয়েছে। ২০১৮ সালের পাঁচ জুলাই তিনি শেষবারের মতো রক্তদান করেন, কারণ অস্ট্রেলিয়ার নিয়ম অনুযায়ী ৮০ বছরের পর আর রক্ত দেয়া যায় না।
মানব কল্যাণ অসাধারণ অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার তাকে ভূষিত করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘মেডেল অফ দা অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া’ ওএএম -এ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসন পরিচিত ‘দ্যা ম্যান অফ গোল্ড আর্ম’ হিসেবেও। নিজের রক্তদানের বিশ্ব রেকর্ড সম্পর্কে এই মহামানব বলেন আমি সত্যিই চাই, আমার এই রেকর্ডটি অন্য কেউ একদিন ভেঙে ফেলুক, তার নামে দাঁড়ায় অন্য আরেকজনও হাজারবারের বেশি রক্তদান করে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করুক।
নিজে এমন বিশেষ একজন হওয়ার পরেও জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসন সবসময় থেকেছেন নির্লোভ। কোনোদিন কারো কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেননি। সবসময় রক্তদান করে গেছেন একদম বিনামূল্যে। সত্যিই তো সোনার মানুষ তিনি। সোনায় মোড়ানো তার সহজ-সরল হৃদয়। খবর : ডেইলিবাংলাদেশ’র।