চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ
আগামী জুনে ওয়াসার উৎপাদন দিনে ৫০ কোটি লিটার হচ্ছে
একটি হেলদি সিটির জন্য সুপেয় পানি ও আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপরিহার্য। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চট্টগ্রাম নগরীর জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিতে চট্টগ্রাম ওয়াসা আইএসও ৯০০১ সনদ পেলেও স্যানিটেশনে পিছিয়ে। আশার কথা হলো, স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের জন্য সুয়্যারেজ প্রকল্প নেয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। নগরীর পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা জানতে সুপ্রভাতের সঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ’র। তা উপস্থাপন করছেন সুপ্রভাতের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুল।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ : চাকরিজীবনসহ পরবর্তীতে ওয়াসার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ মিলিয়ে ১১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ এই সময়ে নগরীর সুপেয় পানির ব্যবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ: ১৯৬৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং তৎকালীন পৌরসভা থেকে পাওয়া ১০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম ওয়াসার। এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল নগরীতে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদন ছিল ৪ কোটি লিটার। আমি চট্টগ্রাম ওয়াসায় সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করি ১৯৬৮ সালে। সেই সময় কেউ ওয়াসার সংযোগ নিত না। আমরা নগরবাসীকে বুঝিয়ে কখনো পয়সা (সংযোগ ফি) নিয়ে আবার কখনো ফি ছাড়া পানির সংযোগ দিতাম। সেই চার কোটি লিটার এখন ৩৬ কোটি লিটারে উন্নীত হয়েছে এবং নগরবাসীর জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য আমরা আইএসও ৯০০১ সনদও অর্জন করেছি। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পানির উৎপাদন ৫০ কোটি লিটারে উন্নীত হবে।
সুপ্রভাত : ওয়াসার প্রথম প্রকল্প কোনটি ?
ফজলুল্লাহ : ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠা লাভের পর ফতেয়াবাদে ওয়াসা প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করে। হালদা নদীর পানি সংযোগ খালের মাধ্যমে ফতেয়াবাদে এনে পানি সরবরাহ প্রকল্পটি নেয়ার জন্য তৎকালীন সময়ে জায়গাও অধিগ্রহণ করা হয়েছিল এবং সেই জায়গা এখনো রয়েছে। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর আর তা অগ্রসর হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের দিকে নেয়া হয় কালুরঘাট আয়রন রিমুভাল প্ল্যান্ট। গভীর নলকূপের পানি থেকে আয়রন পরিশোধন করে তা নগরীতে সরবরাহ করা হয়। এরপর ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্প কোথায় করা যায় তা নিয়ে স্টাডি চলতে থাকে এবং ১৯৮৮ সালে হালদা নদীর পানি পরিশোধন করে মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প চালু করা হয়। যেখান থেকে এখনো দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে আসছে ওয়াসা।
সুপ্রভাত : মোহরার পর দীর্ঘ ২৮ বছর চট্টগ্রামে কোনো পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি কেন?
ফজলুল্লাহ : ১৯৮৮ সালে মোহরা চালুর পর ২০১৬ সালে এসে চালু হয় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হয়ে আসছে। আগামী বছর জুনে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে আরো ১৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদিত হবে। কর্ণফুলী প্রথম পর্যায়ের পর দিনে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পটি। আমি ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পানির উৎপাদনে চারটি প্রকল্প (কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়, মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প এবং ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প) বাস্তবায়ন করছি। মধ্যবর্তী সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কেন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলতে পারছি না।
সুপ্রভাত : স্যানিটেশন ব্যবস্থা একটি স্বাস্থ্যগত শহরের মাপকাঠি। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠার পর এই শহরে সুয়্যারেজ সিস্টেম চালু হয়নি কেন?
ফজলুল্লাহ: এতো বছর এই চেয়ারে যারা ছিলেন তারা করেননি কেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তবে আমি সুপেয় পানি নিশ্চিত করার পর সুয়্যারেজ সিস্টেম নিয়ে কাজ করেছি। ইতিমধ্যে স্যানিটেশন ও ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করেছি। সেই মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে সুয়্যারেজ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পুরো নগরীকে ছয়টি ভাগে ভাগ করে সুয়্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। একটি ভাগে সরকারের পক্ষ থেকে ৩৮০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে এবং প্রকল্প অনুমোদনও হয়েছে। সেই প্রকল্পের দরপত্র আহবান করা হয়েছে। বাকি এলাকায়ও পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু করা হবে।
সুপ্রভাত : সুয়্যারেজ প্রকল্পের পুরো টাকা কি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে?
ফজলুল্লাহ: সরকার যখন কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করে তখন সেই টাকা দীর্ঘমেয়াদে সরকারি তহবিলে আবার ফেরত দিতে হয়। কিন্তু এটি একটি ব্যতিক্রমী প্রকল্প এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা গ্র্যান্ট (অনুদান) হিসেবে দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে সরকারের তহবিলে আর এই অর্থ ফেরত দিতে হবে না। আর এতে বুঝা যাচ্ছে তিনি চট্টগ্রাম শহরের সুয়্যারেজ ব্যবস্থাকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম শহর স্বাস্থ্যসম্মত হলে বিদেশিদের বিনিয়োগও বাড়বে।
সুপ্রভাত : গত কয়েকবছর ধরে পাইপলাইন বসানোর বিড়ম্বনায় নগরবাসীর দুর্ভোগ হচ্ছে। এখন আবার সুয়্যারেজ প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে। এতে তো দুর্ভোগ আরো বাড়বে…
ফজলুল্লাহ : পানির পাইপ বসানো নিয়ে নগরবাসী দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, এজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এই পাইপ বসানোর কারণে আগামী ১০০ বছর নগরবাসীকে আর পাইপ নিয়ে ভাবতে হবে না। গুণগত মানসম্পন্ন পাইপ বসানো হয়েছে। এখন আবারো সুয়্যারেজ প্রকল্পের আওতায় কাজ শুরু হবে এবং নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আবারো হয়তো দুর্ভোগ দেখা দিবে। কিন্তু একটি স্বাস্থ্যসম্মত নগর গড়ে তুলতে নগরবাসীকে এই দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে।
সুপ্রভাত : সুপেয় পানি নিয়ে আপনার টার্গেট কি?
ফজলুল্লাহ : আগামী বছরের মধ্যে দিনে ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদিত হলে নগরীতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। তবে যেহেতু নগর জনসংখ্যা বাড়ছে এবং সেইসাথে পানির চাহিদাও বাড়ছে তাই অবশ্যই নতুন নতুন প্রকল্প নিতে হবে। অন্যথায় একসময় গিয়ে আবারো পানির সংকট দেখা দেবে।
সুপ্রভাত : আবাসিকে পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শিল্প কারখানায় পানির সরবরাহের বিষয়ে কি পরিকল্পনা রয়েছে?
ফজলুল্লাহ : আমরা কর্ণফুলীর ওপারে ভান্ডালজুড়িতে দিনে ৬ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। সেই প্রকল্পের পানি পটিয়া ও আনোয়ারা এলাকার শিল্পকারখানাগুলোতে সরবরাহ করা হবে। একইসাথে মোহরায় দিনে ১৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ক্ষমতার আরেকটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আর তা করা গেলে সীতাকু- ও মিরমরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহ করা যাবে।
সুপ্রভাত : আমাদের ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির উৎস কমে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পানির উৎস সংকোচন নিয়ে কী ভাবছেন?
ফজলুল্লাহ : এটা সঠিক আমাদের ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই পানির সর্বোচ্চ পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে কর্ণফুলী আমাদের পানির প্রধান উৎস। এই নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়বে।
সুপ্রভাত : সাগরের পানি কি পরিশোধন করে ব্যবহার করা যায়?
ফজলুল্লাহ : সাগরের পানি পরিশোধন করে পানযোগ্য করা খুব ব্যয়বহুল। যদি এটা সাশ্রয়ী হতো তাহলে আবুধাবী, দুবাই ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর চারদিকে সাগর থাকলেও তারা পানি আমদানি করত না। সাগরের পানি পরিশোধন করতে প্রতি লিটারে খরচ পড়বে ২০ টাকার বেশি এবং ইকুইপমেন্টগুলো কিছুদিন পর পর নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তা কখনো সাশ্রয়ী হবে না।
সুপ্রভাত : জনবান্ধব ওয়াসা হিসেবে গ্রাহকদের জন্য কী-কী সেবা চালু করেছেন?
ফজলুল্লাহ : নগরীর গ্রাহকদের সর্বশেষ সংযোগ পর্যন্ত পানিতে নির্ধারিত মাত্রায় ক্লোরিন নিশ্চিত করা হয়। এতে নগরবাসীর নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং নগরীতে পানিবাহিত রোগ মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে না। সাতদিনের মধ্যে নতুন সংযোগ, দুই দিনের মধ্যে পানির মিটার পরিবর্তন, বিলে কোনো সমস্যা হলে তা দ্রুত সমাধান, ঘরে বসে পানির বিল প্রদানের (বিকাশ, রকেট প্রভৃতি) সেবা চালু করা, সব ব্যাংকে পানির বিল প্রদানের সুযোগ দেয়া, ইন্টারনেট থেকে গ্রাহক নিজেই বিল ডাউনলোড করতে পারা, বিল জমাদানের পর গ্রাহকের ইমেইলে মেসেজ চলে যাওয়াসহ আধুনিকায়নে অনেকগুলো কাজ করা হয়েছে। আধুনিক নগরজীবনের জন্য যেসব সেবা প্রয়োজন আমরা তা করার চেষ্টা করছি।
সুপ্রভাত : পুরো নগরী কবে নাগাদ সুয়্যারেজ ব্যবস্থার আওতায় আসবে?
ফজলুল্লাহ : আমরা এখন যে প্রকল্পটি নিয়েছি তা ২০২৫ সালে শেষ হবে। আর তা হলে পুরো নগরীর ৬টি ভাগের মধ্যে একটি ভাগের সুয়্যারেজ নিশ্চিত হবে। বাকি ৫টি এলাকার জন্যও বিদেশি সংস্থাগুলো বিনিয়োগেও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যদি সঠিকভাবে মনিটর করা যায় এবং ওয়াসাকে এগিয়ে নেয়া যায় তাহলে ২০৩৫ সালের মধ্যে পুরো নগরীতে সুয়্যারেজের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।