ড. আনোয়ারা আলম »
এর পরের লাইন ‘দম ফুরাইলে ঠুস’ অতি প্রিয় এ গানে ক্ষণস্থায়ী জীবনের ইঙ্গিত। যদিও জীবনযাপনের কারুকাজের ব্যস্ততায় ভুলে যাই বা ভুলে থাকি। একটা মহামারিতে কতো কতো নক্ষত্রের পতন জীবনের আকাশ থেকে। কতো গুণীজন, কতো আপন আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধব। এরপরে ও মনের আকাশ স্বচ্ছ বা আবর্জনামুক্ত হলো না। এখনও প্রতিদিন কতোজন অকালে হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা ভুলে যাই বা ভুলে থাকি যে এ জীবন কতো ক্ষণস্থায়ী এই আছে এই নাই। এরপরে ও হানাহানি – কাড়াকাড়ি – বিভেদ – বিভাজন – কলহ।এরপরে ও আমি সর্বস্ব পৃথিবী। অহংবোধ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য অপবাদ।
ভোগবাদী এ সমাজে আমরা যেন দম দেওয়া পুতুল। ভেতরে ও বাইরে যোজন যোজন ফারাক। ফানুসের মতো ফাঁকা ভেতরে।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্তান ও বাবা মা ছাড়া আর সব তুচ্ছ। অন্য জায়গায় কেবলই লেনদেন বা বিনিময়। ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব এতো ক্ষণস্থায়ী। তবে অশনিসংকেত হলো বাবা মা’কেও অনেক সন্তান পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানও হুমকির মুখোমুখি। এর পরিবর্তে লিভ টুগেদার বা সেপারেট ম্যারেজ সংস্কৃতিতে ঢুকে যাচ্ছি নীরবে। দাম্পত্য জীবনে ও এক ঘনঘোর অন্ধকার। সম্পর্কে জটিলতা, ইগো সমস্যা বা বহুগামিতা। তাই বাড়ছে আত্মহত্যা।
ফেসবুক এখন নিত্যসঙ্গী। বায়বীয় সম্পর্কে হাজারো বন্ধু। আছে লাইক, কমেন্টস বা সহানুভূতি। তবে একই সাথে তর্কে বিতর্কে বা একে অপরকে আঘাত বা খোঁচা এবং ব্লক। তখন মনে হয় এটি কি বন্ধুত্ব। তাহলে এটিও দাঁড়িয়ে আছে এক শূন্যতার ওপর।
রাজনীতিবিদরা একসময়ে জনগণের বন্ধু ছিলেন। এখন! কেবলই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। জনগণ তাঁদের হাতিয়ার। সুন্দর বচনে বা আত্মপ্রচারে কি প্রতারণা। এমন কি নির্বাচিত ছাত্র সংসদ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না থাকলেও দেখি ছাত্র সংসদ। কিন্তু চাবিকাঠি কিছু নেতাদের হাতে। অতএব দলাদলি বা মারামারি।
শুধু কি রাজনীতিবিদরা! কিছু বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর মানুষের ভেতরও চামচা গিরি। যদিও তাঁদের হারাবার কিছু নেই। অথচ তাঁরাই বদলাতে পারেন সমাজকে বা জাতিকে।
দেশে গড়ে উঠেছে এক মাফিয়া চক্র। দুই চেহারা তাঁদের। একদিকে জনসেবা অন্যদিকে কালোবাজারি বা টাকা পাচার। গড়ে তুলেছে এক সিন্ডিকেট। চিড়ে-চ্যাপ্টা হচ্ছে জনগণ। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
দুর্নীতি বা মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলি। শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে পাঠদান। কিন্তু এখানেও দলাদলি বা কোন্দল। এখানেও কোচিং বাণিজ্য। সরকার কোটি কোটি টাকার বই দিচ্ছেন এরপরে ও গাইড বুক ব্যবসা রমরমা।
চিকিৎসা খাতে যতো দক্ষতা ততো প্রসার। এখানেও রোগীর লাইন যতো দীর্ঘ ততো চিকিৎসকের আচরণে বা সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতা। তাই তো দেশের বাইরে হাজারো রোগী চলে যাচ্ছেন লাখো টাকা খরচ করে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা বলি। যতো অপরাধ ততো লাভ। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর মামলা যতো বেশি আইনজীবীদের ততো লাভ। তাইতো মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমে না।
সরকারি অফিসে বা সেবাখাতে নিয়োগ বা বদলি বাণিজ্য রমরমা।
সভ্যতার ক্রমবিকাশের মূলমন্ত্র ছিল সত্য ও সুন্দরের সাধনা তথা মানুষের মুক্তি। কিন্তু মানুষের পায়ে এখন এক অদৃশ্য শেকল। গণতন্ত্র মানে মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা মানুষকে নিয়ে এটি এখন শুধু প্রবাদ বাক্য।
চোখের সামনে দেখছি উন্নত বিশ্বের কি দাপট। অবলীলায় মানুষ মারছে লাখে লাখে। কিন্তু কোন প্রতিবাদ নেই। শুধু তাদের মোড়লপনা তৃতীয় বিশ্বের ওপর। আহা! ক্ষমতার কাছে পুরো পৃথিবী কিভাবে নতজানু।
এরপরেও কথা থাকে। এরপরেও কিছু ভালো মানুষ বা কিছু তরুণ সমাজ মানুষের জন্য কাজ করছে। সৃজনশীল চর্চায় নিজেদের নিবেদিত রেখে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যর্থতা আমাদের। তাদের আলোতে নিয়ে আসতে পারছিনা।
দরকার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব সততা, আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে তাঁদের সামনে নিয়ে আসা। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা বা শূন্যতা বা ঘাটতি। আমরা চাই হতাশার কালো মেঘ কেটে যাক। সূর্যের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হোক চারপাশ। নেমে আসুক শান্তি। সবার ওপরে মানুষ সত্য এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক।