বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়
ভূঁইয়া নজরুল »
মোহরা ওয়ার্ডের হামিদচরের বাসিন্দা মহব্বত আলী কর্ণফুলী নদীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেন, ‘এখন যেখানে মাটি ভরাট দেখতে পাচ্ছেন, সেখানে কয়েক বছর আগেও ছিল পানি। জোয়ারের সময় পুরো এলাকাটি ডুবে যেতো। আর এখন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়।’
মহব্বত আলীর মতো স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই উচ্ছ্বসিত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।
তবে হামিদচরের চিত্র এই পর্যায়ে আনতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘তিন বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার কাজে নদী পথে যেতে হয়েছে। দুর্গম এক এলাকা ছিল হামিদ চর। দুই পাশে ছিল পানির প্রবাহ ও মধ্যখানে চর। এখন উপকূলের সাথে চরের মিলন ঘটিয়ে ১০৬ একর জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস।’
তিনি বলেন, ‘সাগরের নীল অর্থনীতির নেতৃত্ব দিতে দক্ষ জনবল এই ক্যাম্পাসেই গড়ে উঠবে। বিদেশি পরামর্শক থেকে মুক্তি পাবে দেশ। দেশের মেধাবীরাই আমাদের মেরিটাইম সেক্টরে নেতৃত্ব দেবে।’
কবে নাগাদ শুরু ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ?
কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে সম্প্রতি সিডিএ’র নির্মাণাধীন রোড দিয়ে গিয়ে দেখা যায়, হামিদচর এলাকায় নদীর দিকে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। কর্ণফুলী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভরাট করা হচ্ছে এলাকাটি। দূর থেকে বিস্তীর্ণ বালির মাঠ মনে হলেও কাছে এলে মাটি ভরাটের চিত্র দেখা যায়। রাস্তা ও নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় চলছে এই ভরাট কাজ।
২০১৩ সালে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রণয়নের পর ২০১৫ সালে ঢাকার মিরপুরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে দেশের ১২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালে বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনের পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের মোহরার হামিদচরে নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত দুই বছর ধরে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে হামিদচর ভরাটের কাজ চলছে। এখন এই ভরাট কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘সমুদ্র সমতল থেকে রাস্তার উচ্চতা ১০ মিটার। আমরা ক্যাম্পাসের উচ্চতা রাখছি ৮ মিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই উচ্চতায় ক্যাম্পাসটি নির্মিত হবে। আমাদের ডিটেইলড ডিজাইন সম্পন্ন হয়েছে। মাস দুয়েক পর আমরা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করবো।’
তিনি আরো বলেন, এই এলাকার মাটি তরলায়িত (লিকুফিকেশন) হওয়ায় এখানে পাইলিং খরচ বেশি। এজন্য ইতিমধ্যে আমরা ১৩৯টি পয়েন্টে বোরিং কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। বিভিন্ন উচ্চতার ৩৫টি ভবন এই ক্যাম্পাসে নির্মিত হবে।
কি কি থাকছে ক্যাম্পাসে?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে হবে না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে আবাসনের ব্যবস্থা করছি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় চাকুরে সবার থাকার ব্যবস্থা হবে। একইসাথে তিনটি ছাত্রাবাসের দুটি মেয়েদের এবং একটি ছেলেদের হবে। এছাড়া থাকবে ডরমেটরি।’
তিনি আরো বলেন, এই ক্যাম্পাসে প্রাথমিকভাবে ছয় হাজার শিক্ষার্থী একসাথে অধ্যয়ন করতে পারবে এবং ধীরে ধীরে তা বাড়িয়ে ১২ হাজারে উন্নীত করা হবে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী হবে বিদেশি।
অনার্সের প্রথম ব্যাচ কবে বের হবে?
২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কোর্স চালু হলে ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাচ শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হয়ে যাবার কথা। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি দুটি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সে পাঠদান করে আসছে। এতে কয়েকটি ব্যাচ ইতিমধ্যে বের হয়ে গেছে। তবে অনার্স কোর্স বের হবে কিছুদিনের মধ্যে। এই ব্যাচটি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এবং মেরিটাইম সেক্টরে স্বনির্ভরতা আনতে আমাদের দেশের ছেলেরা তৈরি হচ্ছে। প্রথম ব্যাচের অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীরা শিগগিরই ডিগ্রি নিয়ে বের হবে। একইসাথে বর্তমানে ৫টি ডিপার্টমেন্টে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
তিনি আরো বলেন, ‘এখানকার শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের আরো তৈরি করতে পারে সেজন্য বিশ্বের আরো ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কোলাবরেশন করা হয়েছে। উন্নত শিক্ষার জন্য তারা সেখানে যেতে পারবে।’
ইতিমধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বেড়েছে। গত বছর যেখানে ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১০ হাজার আবেদন করেছিল এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার। অর্থাৎ বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পড়তে চায়।
নির্ধারিত সময়ে কি ক্যাম্পাস নির্মাণ শেষ হবে?
বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে দুটি ভাড়া ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০১৮ সালের ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের বাজেট ১১৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত আকারে এই বাজেট আরো বাড়বে।
কিন্তু কবে শেষ হবে- এই প্রশ্নের উত্তরে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ২০২৩ সালের মধ্যে দুটি একাডেমিক ভবন, দুটি ছাত্রাবাস এবং আরো কিছু প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ শেষ করা। আর তা করে ২০২৩ সালে কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট চালু করা। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে আরো কিছু ডিপার্টমেন্ট চালু করা এবং ঢাকার একটি ভবন ছেড়ে দেয়া। ২০২৫ সালে ফাইনালি পুরো ক্যাম্পাস এখানে শিফট করার টার্গেট।’
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১২ মার্চ ভারতের সাথে সমুদ্র বিজয়ের পর ব্লু ইকোনমির প্রতি সরকারের দৃষ্টি। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। আর চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে হামিদ চরে হতে যাচ্ছে সেই দক্ষ জনশক্তি তৈরির কারিগর। আবার এই এলাকার পাশেই গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে চট্টগ্রামের সকল সরকারি অফিসগুলোর দপ্তর।