সুপ্রভাত ডেস্ক »
বৈশ্বিক বাস্তবতা আর নানামুখী চাপের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভোটের আগে নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা) চেয়ে ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৫.২১ শতাংশের সমান।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৪.২৪ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৫.২৩ শতাংশের সমান।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। খবর বিডিনিউজের।
গতবছর বাজেট দিতে গিয়ে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়’ প্রত্যাবর্তনের সংকল্প করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে পরিবর্তিত বিশ্ব বাজার, জ্বালানি ও ডলার সঙ্কট এবং মূল্যস্ফীতি তার সেই প্রত্যাবর্তনের গল্পটা মধুর হতে দেয়নি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে হাঁটতে হয়েছে কৃচ্ছ্রের পথে। তার ওপর বিদেশি মুদ্রার ভা-ারে স্বস্তি আনার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিতে গিয়ে আর্থিক খাতের নানামুখি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে।
সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বছরে এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের বছরে জনতুষ্টির খুব বেশি সুযোগ রাখার পথ মুস্তফা কামালের সামনে নেই। তারপরও স্মার্ট বাংলাদেশে পৌঁছানোর নির্বাচনী স্লোগানটিকেই তিনি বাজেটে ফিরিয়ে এনেছেন। তার এবারের বাজেটের শিরোনাম ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার; দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়; মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে; বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে; রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে; বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ।’
‘শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে। সকলের দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়নসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।’
২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বাজেটগুলোতে উন্নয়ন খাত বরাবরই বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছিল। কিন্তু মহামারীর ধাক্কায় সেই ধারায় কিছুটা ছেদ পড়ে।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় এবার বিশ্বের অনেক দেশে মন্দার ঝুঁকি থাকলেও বাজেটের আকার বাড়িয়ে পরিকল্পনা সাজানোর পুরনো ধারায় যতি দেননি মুস্তফা কামাল।
৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে এবার উন্নয়ন ব্যয় ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে।
এবার পরিচালন ব্যয় (ঋণ, অগ্রিম ও দেনা পরিশোধ, খাদ্য হিসাব ও কাঠামোগত সমন্বয় বাদে) ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৪.৭২ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা যাবে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ের আরও প্রায় ১৬.২০ শতাংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় হয়ে, যার পরিমাণ অন্তত ৭৭ হাজার কোটি টাকা।
মহামারির ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করলে বেড়ে যায় আমদানি। তাতে সরকারের জমানো ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়। রপ্তানি বাড়লেও আমদানির মত অতটা না বাড়ায় এবং রেমিটেন্সের গতি ধীর হয়ে আসায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
এর মধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য আর জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ডলার বাঁচাতে সরকার বিলাস পণ্য আমদানিতে লাগাম দেওয়ার পাশাপাশি কৃচ্ছ্রের পথে হাঁটতে শুরু করে।
রাজস্ব আহরণে এনবিআর বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও কামাল আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রায় ৬৬ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন।
তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১৫.৫০ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন কামাল। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৬ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৬.৪৪ শতাংশের মত।
গতবারের মত এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১২ শতাংশের মত। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। সংশোধনে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা করা হয়।
আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৪৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৬০ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৬৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এছাড়া বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, সংশোধনে তা সামান্য কমিয়ে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা করা হয়, যদিও মার্চ পর্যন্ত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, ব্যয় দক্ষতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয়ী অর্থায়নের দেশি-বিদেশি উৎস অনুসন্ধান হবে রাজস্ব খাতের নীতি-কৌশল। রাজস্ব আহরণে সকল সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে চাই।’
‘রিটার্ন দাখিল পদ্ধতি সহজীকরণসহ অন্যান্য সংস্কারের মাধ্যমে কর নেট সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয় ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মূল্য সংযোজন কর আদায় সহায়ক ইলেক্ট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস স্থাপন ও সম্প্রসারণ, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন, কর প্রশাসনের অটোমেশন ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে কর রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে।’
২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশোধনে তা ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব সংসদের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে রেকর্ড ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫.২ শতাংশের সমান।
সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হয়। তবে টাকা যোগানোর চাপ থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই তা সম্ভব হচ্ছে না।
বরাবরের মতই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর।
তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি তিনি মেটাবেন।
অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ৯ মাসের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থবছর শেষে তা ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ হবে বলে সরকার ধারণা করছে।
তারপরও অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।