স্নেহ

জসিম মনছুরি »

বাবা বয়স্ক লোক। আশি ছুঁই-ছুঁই। এ বয়সেও হাঁটাচলা মোটামুটি ভালোই করতে পারেন। চশমা ছাড়াই কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে পারেন। বাবার শ্বাসকষ্ট ছিলো, এখন ভালো। যৌবনে তাঁর হাঁকডাক ছিলো তেজোদীপ্ত সিংহের মতো। ভয়ে আমরা জড়সড় হয়ে থাকতাম। তিনি খুব রাগী ছিলেন। রাগ উঠলে বাঘের মতো হুংকার দিতেন। এখন আর সেই রাগ নেই। একেবারে মাটির মানুষ। নাতিরা যতই দুষ্টুমি করুক না কেন, নীরবে সয়ে যান।
এত বছর ধরে বাবার শাসনটা দেখে আসছি। আড়ালে যে বেশুমার স্নেহ লুকিয়ে ছিলো তা কখনো উপলব্ধি করিনি। আমাদের সম্পর্কটা ছিলো মায়ের সাথে। অভাব-অভিযোগ যত যা, সব মায়ের কাছেই শেয়ার করতাম। তিনি শিক্ষিত হলেও আমাদের পড়ালেখার দায়-দায়িত্ব যেন মায়ের ওপর।
বাবা অতিথিপরায়ণ লোক। খাবার সময় যে কোনো একজনকে অবশ্যই নিয়ে আসবেন। তরকারি যাই থাকুক না কেন, ইতস্তত বোধ করার কোনো কারণ ছিলো না তার। এমনকি শাক-সবজি হলেও তাই দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। পরোপকার করে বেড়াতে বেড়াতে আমাদের উপকার তেমন একটা হতো না। তাতে কি! আম্মা তো আছেনই।
ছোটবেলায় আমি ক্রিকেট খেলতাম। বাবা ক্রিকেট ভক্ত ছিলেন। খেলায় আমাকে বরাবরই সাপোর্ট দিতেন। আমি মাঠে খেলতাম। বাবা সক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। চার-ছক্কা মারলে করতালি দিতেন। আমার বোনের আকদ অনুষ্ঠানের দিনেও আমি ক্রিকেট খেলতে গেছি। বাবার সাপোর্টে এসব করতে পেরেছি। আমি সবার বড় হওয়াতে আমার প্রতি স্নেহের পরিমাণটাও ছিলো খুব বেশি। আমি মেধাবী স্টুডেন্ট হওয়ায় প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতাম। বাবা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। হাটেবাজারে বন্ধুদের কাছে আমার প্রশংসা করে বেড়াতেন। ইন্টার পরীক্ষা দিচ্ছি। বাবা প্রতিটি পরীক্ষায় গিয়ে হাজির। আমি পরীক্ষা দিচ্ছি বাবা তীর্থের কাকের মতো বাইরে অপেক্ষা করছেন। পরীক্ষা দিয়ে বের হলে প্রশ্ন হাতে নিয়ে এাঁ-ওঠা জিজ্ঞেস করবেন। আমার খুব ভয় হতো। পরীক্ষায় লিখতে না পারলেও লিখেছি বলে চালিয়ে দিতাম। বাবা খুশিতে কোমল পানীয়-ডাব ইত্যাদি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি মহানন্দে খেয়ে নিতাম। পরীক্ষা চারটি দেয়া হয়েছে। পঞ্চম পরীক্ষা দেবার জন্য যাচ্ছি, এমন সময় রজনী মাঠের কর্নারে এক দুর্ঘটনা ঘটে। অ্যাক্সিডেন্টে আমার পায়ের হাড় ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। ওই বছর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তখন বাবার স্নেহ-মায়া উপলব্ধি করতে পেরেছি। বাবা ছোটদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করেছেন। আমার জন্য লক্ষ টাকা খরচ করেন। তখন থেকে বাবার আন্তরিকতাটা আমার প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। বাবা বলতেনÑ
বাবা : তোত্তুন পড়ালেহা গরা পরিবো। পড়ালেহা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই।
আমিও আমার মতো করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের সেরা কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছি। চাকরিও করছি ভালো প্রতিষ্ঠানে। হ্যান্ডসাম সেলারি। দিনকাল ভালো যাচ্ছে। বাবা কোনোদিন বেতনের কথা জিজ্ঞেস করেননি। বাবাকে চা-নাশতার জন্য হাতেগোনা কিছু টাকা দিতাম। তবে তাঁর জন্য বেশ ফল-ফ্রুট নিতাম। বাবা খুশিই হতেন। সবাইকে বলে বেড়াতেন- এক মাসে যে ফল-ফ্রুট আমি তাঁর জন্য নিই, অন্যকেউ বছরেও সেই ফল-ফ্রুট কিনে না। কি জানি! আমি কতটুকুইবা নিতাম। আমি মনে করি, এটা বাবা বলে বাড়িয়ে বলা। প্রশংসা শুনে আমারও ভালো লাগে। ঈদ-কুরবানিতে ১০-২০ হাজার টাকা হয়তো দিতে পেরেছি। এ টাকায় তিনি ১০-২০ লক্ষ টাকা পাওয়ার মতো খুশি হতেন।
ইদানিং ফ্যামিলি নিয়ে কর্মস্থলের পাশাপাশি শহরে বাস করছি। আগে প্রতি সপ্তাহে গ্রামে যাওয়া হলেও এখন তেমন একটা যাওয়া হয় না। বাবা আগে তেমন একটা কল না দিলেও এখন রোজ সকালে কল দিয়ে খোঁজখবর নেন। সম্প্রতি আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। বাবার টেনশন বাড়ে। এখন রোজ দুই বেলা কল দিয়ে খোঁজ নেন। আমি ঈদ কখনো বাইরে করিনি। অসুস্থতার কারণে এবারের ঈদ শহরে করার সিদ্ধান্ত নিই। তাই ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি। ঈদের দিন সকালে ছেলেমেয়েরা সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে। আমারও ভালো লাগছিলো না। ঈদের জামাত পড়ে আসলাম। দেখি বাবার কল। বাবা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেন না। বাবার এ রকম কান্না জীবনে কখনো দেখিনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসুস্থতা নিয়ে ঈদের দিনেই বাড়ি চলে যাই। আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবার সেকি কান্না। বিভিন্ন ভাবে আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন- এটা করিস না, ওটা করিস না; এখন রুটিনমাফিক চলতে হবে ইত্যাদি । ঈদের মাসখানেক পর আমি আর আমার বড় ছেলে তাঁকে দেখতে যাই। আমি খেয়াল করে দেখি, বাবার স্নেহটা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। পানির কলে গোসল করছিলাম। বাবাও সঙ্গে এলেন। চুপিচুপি বললেনÑ
বাবা : তুই ক্যান গরি চলঅর?
আমি : আল-হামদুলিল্লাহ, হনো সমস্যা নঅর আব্বা।
বাবা : তুই সমস্যা অইলেও ত নঅ হবি?
আমি : না বাবা, হনো সমস্যা নঅর।
বাবা : চইল আর মাছ লই যাবি। তইলে আর সমস্যা নঅ অইবো।
সেদিন বিকালে আমি শহরে চলে আসার জন্য বের হবো, এমন অবস্থায় বাবা গোপনে আমার ছেলের হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন। বললেন, কেউ না দেখে মতো রেখে দাও। যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়া দিও। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। বাবাকে আমার দেয়ার কথা কিন্তু তিনি কিনা আমাকে দিচ্ছেন। এ কথা ভাবতে আনন্দে অশ্রু গড়িয়ে এলো। বাবা এ বছর ঈদ সালামিও দিয়েছিলেন। ৫০ টাকা সেলামি। যা ইতোপূর্বে কোনো ঈদে পাইনি। বাবাকে বললাম, আমি এমফিল করতে চাই। দোয়া করবেন। বাবার চোখের কোণায় দেখলাম বিন্দু বিন্দু জল এসে জমা হয়ে গেছে। বাবা পকেটে হাত দিলেন। ৫০০ টাকার আরেকটি নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোকে দোয়া করছি, তুই এমফিল কর। এটাই আমার সাফল্য, এটাই আমার চাওয়া। বাবা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আমরা শহর পানে ছুটছি আর বাবা অপলক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রইলেন। হাতে রুমাল ছিলো তাঁর। পেছন ফিরে দেখতে পাই, তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন।