নিজস্ব প্রতিবেদক >
‘ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতারসের মতো অলক্ষ্যে।’ নজরুল লিখেছিলেন তাঁর ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে। যন্ত্রশিল্পীরা তেমনই গোপন থাকেন। ফুলের মাঝে যেমন মাটির মমতা থাকে তেমনি একটা সার্থক গানে লুকিয়ে থাকে বাদ্যযন্ত্রশিল্পীদের মমতা। তাঁরা গোপনে যুগিয়ে যান রসধারা। তেমনি একজন ছিলেন সুব্রত বড়ুয়া রনি। গায়ককে যুগিয়েছেন রস¬Ñ তালে ও ছন্দে। সংগীতভুবনে সুপরিচিত সোলস-এর প্রতিষ্ঠাতা ড্রামার রনি দা। চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০২০ সালে করোনা মহামারির আগে। শুরুর দিকে তার সংক্রমণ বাড়লেও চিকিৎসকরা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো। চলে গেলেন ৬৫ বছর বয়সে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে গতকাল বুধবার ভোরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ওদিন বিকাল তিনটায় তাঁর মরদেহ নিজ জন্মস্থান চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার জন্য চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি ও চারুকলা ইনস্টিটিউটে রাখা হয়। পরে নগরের নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরে ধর্মীয় রীতিতে তাঁর শেষকৃত্য শেষে চান্দগাঁও বৌদ্ধ মহাশ্মশানে দাহ করা হয়।
ড্রামার রনি দা
‘তবলার বোলে তার সংগীতজীবন শুরু। হাতে-কলমে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ তাঁকে একজন গুণীশিল্পীরূপে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। তাবলার বোল, তাল, লয় প্রয়োগ করেন কঙ্গো বাদ্যযন্ত্রে। এই কঙ্গো বাজালেন অনেক গানে। প্রকৃত শিল্পীরা একটা বিষয়ের জ্ঞানকে বিকশিত করে ব্যবহার করেন অন্য অরেকটি সৃষ্টিশীল কাজে। তবলার সেই জ্ঞানকে তিনি ব্যবহার করেন ড্রামে। হয়ে উঠলেন ড্রামার রনি দা।
সুরেলা থেকে ‘সোলস’, তারপর…
সোলস’ গড়ে ওঠার সুখস্মৃতি নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। ‘আমাদের বাড়ি-মায়ার ছায়া’ ফেসবুক পেজের পূর্বাপর এর প্রথমপর্বে বলেছিলেন, ‘আমরা গানের দল গড়ে তোলার প্রেরণা পেয়েছিলাম স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনে। বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গানগুলো গানের দল তৈরি করতে আমাদের উদ্ধুদ্ধ করে। ১৯৭২ সালে আমরা কয়েকজন গড়ে তুলেছিলাম প্রান্তিক শিল্পীগোষ্ঠী। পরবর্তী সময়ে আমি, মমতাজুল হক লুলু, আহমেদ নেওয়াজ, ওয়াদুদুল ইসলাম ও এনায়েত ‘সুরেলা’ ব্যান্ডদল গড়ে তুলি।
এই ‘সুরেলা’ ব্যান্ডদলের নাম দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক মাহ্বুব উল্ আলম। তখন আমরা সাধারণ বাদ্যযন্ত্র দিয়ে প্রোগ্রাম করতাম। পরে ওয়াদুদুল ইসলাম ইলেট্রিকযন্ত্র কেনার টাকা দেন। ইত্তেফাকের সাংবাদিক মঈনুল আলম ভারত থেকে ইলেট্রনিকসযন্ত্র এনে দিলেন। সেই থেকে ওয়েস্টার্ন ধরনে ‘সুরেলা’ হয়ে গেল ‘সোলস’। পরবর্তী সময়ে সোলস-এ যুক্ত হন তপন চৌধুরী, লরেঞ্জো পল, রুডি টমাস, নকিব উদ্দিন খান, শাহেদুল আলম, কুমার বিশ্বজিৎ,আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ বড়ুয়া।
সব্যসাচী সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক
চারুকলা, নাটক, আবহসংগীত ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সব জায়গাতে তিনি মুখর ছিলেন। ছিলেন চারুকলার দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। কর্মাশিয়াল ডিজাইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ২০০৩ সালে চারুশিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘চারুশিল্পী সম্মিলন পরিষদ’। ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব। ১৯৭৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন কাজ করেন অরিন্দম নাট্যসম্প্রদায়ে। তোরা সব জয়ধ্বনি কর, লালসালু’সহ অনেক নাটকে আবহসংগীতের কারিগর ছিলেন। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
রুধির ধারার মতো গোপনে কাজা করতে-করতেই হারিয়ে গেলেন শিল্পী গড়ার শিল্পী রনি দা।