কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম :
সকাল হতে না-হতেই কণ্ঠসাধনা। বিপুল দাসের ঘুম ভেঙে যায়। সে আধঘুমো ইন্দ্রাণীকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, তোমার দাদা আর কতদিন আমাদের জ্বালিয়ে মারবে? সেই দু’বছর ধরেই তো শুনে আসছি রনবীর দা’ কলকাতা ফিরে যাবে। কিন্তু এখন তো দেখছি, দিন দিন ঘাড়ের ওপর চেপে বসছে।
ইশ, ইশ! দাদা শুনতে পাবে! ইন্দ্রাণী আঁচলে শরীর ঢেকে বলে।
ওদিকে রনবীর থামার পাত্র নয়। সে গলা ছেড়ে গেয়েই চলেছে … আ… আ… আ…। বিল্ডিংয়ের দারোয়ান মফিজ প্রচ- গরমে ভিজে যাওয়া বিছানা থেকে জেগে ওঠে। রাতের সেহরির কথা ভাবতে থাকে। আহ, কতদিন পর গরুর মাংস দিয়ে পেটভরে খেলাম। কিন্তু সিঁড়িঘরের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর পেট থেকে নিঃসৃত ভ্যাপসা গন্ধটা পুরো সকালটাই মাটি করে দেয় মুহূর্তে। ওদিকে রনবীর বাবুর বিরক্তিকর কণ্ঠসাধনা মফিজের এই আধঘুমো অবস্থাটাকে আরও বেসামাল করে তুলে। সে সিঁড়িঘরের একেবারে প্রান্তে যতেœ লুকিয়ে রাখা ব্যাগের ভিতর থেকে স্যামসাং সেটটা বের করে আনে। তারপর অডিও অপশনে গিয়ে সাঈদীর ঝাঁজালো ওয়াজটা ছেড়ে দেয়।
বেটা এবার বুঝ, সকাল হতে না-হতেই তোদের গানচর্চা। বেটা এবার আমাগো ওয়াজ শোন্। হারামজাদা মূর্তিপূজারী!
সকাল আটটা পর্যন্ত কণ্ঠসাধনার পরও রনবীরের মুখে কিছু ভাজি-রুটিও জুটলো না। তাই সে ভাবলো, ফিরিঙ্গিবাজারে একবার ঢুঁ মারা যাক। যদি কোনো হিন্দু হোটেল খোলা পাওয়া যায়। তবে না হয় যেকেনোভাবে ক্ষুধার জ্বালাটা মেটানো যাবে।
অগোছালো রুম থেকে কোনো মতে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতেই সিঁড়িঘরের নিচেই রনবীরের সাথে মফিজের দেখা।
রনবীর : আমার কোনো চিঠি পেয়েছ?
মফিজ: না স্যর, আমি পোস্টম্যানকে বলে রেখেছি; চিঠি পেলেই আপনাকে জানাবো।
বিল্ডিংয়ের ঢালটা পেরোতেই রনবীরের ভীষণ বিরক্তি লাগে। কারণ জমাটবাধা নালার উটকো গন্ধ তাকে সব সময় বিচলিত করে তোলে। সেই শৈশব থেকে আজ অবধি সে কেবল নেড়ি গলির উটকো গন্ধ থেকে মুক্তি চেয়েছে বারবার। কিন্তু নিয়তিটাই তার এমন, সে যেখানেই গেছে কেবল এই নেড়ি গলি আর এঁদো নালাগুলোই তাকে কাছে টেনেছে। জীবনের একটা সময়ে সে দেশান্তরিত হয়ে কলকাতায় থিতু হতে চেয়েছে। কিন্তু নিয়তি তার একটিই। জীবনটাকে যেকোনভাবে মাড়িয়ে যাবার প্রক্রিয়া।
২
গায়ত্রী বসেছিল বারান্দায়। আজকের বিকেলটা তার অসাধারণ লাগছে। সে সাততলা তলা থেকে পুরো করুণাময়ী সল্টলেক সিটির সৌন্দর্যটা উপভোগ করছে আর তা নতুন কেনা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছে।
মা, ছবিটা কিন্তু দারুণ হচ্ছে। দূরের বিল্ডিংগুলো কি আরও কালারফুল করবে? ঐন্দ্রিলা প্রশ্ন করে।
দেখা যাক মা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি বলে।
পাশের ঘরে মোবাইলফোন বেজে ওঠে। রনবীরের ফোন। প্রতিবারের মতোই ঐন্দ্রিলা ফোন রিসিভ করে বলে,
বাবা, তুমি কবে ফিরবে? আর প্রতিবারের মতোই রনবীর উত্তর দেয়, এই তো মাসখানেক এর মধ্যেই ফিরছি। তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?
ভালো।
ভিডিওতে ক্লাস চলছে?
জি বাবা।
আম্মু কেমন আছে বলতেই গায়ত্রী ইশারা দেয়, কিছু না বলতে।
মোবাইলফোনটা টেবিলে রেখে রনবীর পাশে উপবিষ্ট মনোয়ারকে বলে, বাংলাদেশে আর মন টিকছে না। আমার মামণিকে কতদিন দেখিনি।
কথাগুলো শুনে মনোয়ার অভিব্যাক্তিহীনভাবে তার পোড়খাওয়া ঠোঁট দুটি বাঁকা করে আর বলে,
গেলে যাবেন; তাতে আবার তাড়া কিসের? কিন্তু যাওয়ার আগে আমার ইলেস্ট্রেশনগুলি শেষ করে দিয়ে যাবেন। রনবীর বলে, তা তো বটেই। অগ্রিম যখন নিয়েছি কাজটা শেষ করবো না, তা কি হয়?
মিনিটখানিকের মধ্যে পুরো প্রকাশনী হাউজ হাউজফুল হয়ে ওঠে। পা-ুলিপিসমেত উদয় শংকরদার মুখোমুখি হতেই রনবীর মনোয়ারকে বলে, আজ চললাম তাহলে। আগামীকালের মধ্যেই তুমি ডা. মাহফুজের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদখানা পেয়ে যাবে, আশা করি। রনবীর লম্বা-লম্বা পা ফেলে দ্রুততার সাথে প্রকাশনী অফিস ফেলে আসতেই গলির মোড়ে সহপাঠী পিয়ালের সাথে দেখা। সে রনবীরের দিকে চোখ রেখেই সিগ্রেট টেনে চলেছে। রনবীরের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে প্রশ্ন করে, ‘বন্ধু কেমন আছিস? বিয়ে করেছিস?’ কিন্তু তরুণ বয়সের বৈরিতা কি সহজে ভোলা যায়? তাই সে পিয়ালের কৌতূহলী চোখগুলি এড়িয়ে নেমে পড়ে চেরাগি পাহাড়ের ঢালে। যেখানে পা রাখলেই তার অতীত-বর্তমান, ভবিষ্যত সবই এক হয়ে যায় হু হু করে। হাঁটতে-হাঁটতে সে ঢুকে পড়ে লাইব্রেরিতে। নতুন কোনো বইয়ের খোঁজে, নতুন কোনো আইডিয়ার খোঁজে।
৩
হাতে-গায়ে ট্যাটু লাগানো সোমনাথ সকাল থেকেই ব্যস্ত তার সদ্য কেনা টাটা সাফারি জিপটি নিয়ে। আজ তাতে চড়ে পুরো ফ্যামেলি সেন্ট্রাল-পার্কে যাবে। সদা হাস্যোজ্জল, বলিষ্ঠ সোমনাথ নিলাকে বলে, বুঝলে বেশি কিছু করতে যেও না। এই খিচুড়ি আর ছাগল ভুনাই যথেষ্ট। মৈরী দাবার গুটিগুলো হাতে নিয়ে বলে, বাবা ঐন্দ্রিলাও কি আমাদের সাথে যাবে?
ওদের আমরা করুণাময়ী থেকে পিকআপ করবো, সোমনাথ উত্তর দেয়। ছোট্ট মায়াকে আগেভাগেই ব্রিজিকে নিয়ে উঠতে দেখে, নিলা বলে ওঠে, মামণি ব্রিজিকে গোসল করিয়েছ?
হ্যাঁ মা, আমি আর আপু মিলে কলের নিচেই ওকে গোসল করিয়েছি, মায়া উত্তর দেয়।
গাড়ি চলছে দুর্বার গতিতে। ড্রাইভিং সিটে জিনস প্যান্ট আর টি-শার্টে সোমনাথকে নিনার কাছে বিশ বছর আগেকার সেই সোমনাথই মনে হচ্ছে। সে হাসে আর সিডি- প্লেয়ারটি ছেড়ে দেয় : ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ …
গানের শেষে সোমনাথ বলে, ‘কেন যে রনবীর বিয়েটা করলো? আমি বুঝি না। বিয়ের আগেই আমি বলেছিলাম, দ্যাখ তুই কিন্তু ভবঘুরে, বৌ চালাবি কি করে?’
নিলা বলে, ‘সে কথা বলে আর কি হবে? ঐন্দ্রিলার বয়সও যখন ষোল হওয়ার পথে; এখন আমাদের কর্তব্য ঐন্দ্রিলা আর গায়ত্রীর দেখভাল করা। জেনে-শুনেই তো শালিকে তুলে দিলে এক পাগলবন্ধুর হাতে।’
কিন্তু নিলা বিয়ের আগে তো ওর এই খারাপ দিকগুলো কখনও আমাদের চোখে পড়েনি! মায়া ব্রিজিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। জিপখানা করুণাময়ী ই-ই ব্লকে বাঁক নিতেই মৈরী চিৎকার করে ওঠে, ঐ যে ঐন্দ্রিলা!
এবার আমরা ছয়জন সেন্ট্রাল পার্কে খিচুড়ি খাবো, সোমনাথ বলে। ছয়জন কেন? আমরা সাতজন, মায়া ব্রিজিকে জড়িয়ে ধরে বলে। নিলা আর গায়ত্রী হাঁটতে-হাঁটতে গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা লেকের পাড়ে বসে পড়ে। দক্ষিণের মনমাতানো বাতাস বয়ে চলে। গায়ত্রী বলে, আপু তুমি, ‘তুমি রবে নীরবে … গানটা গাও না। ওটা সব সময় গেয়ে আসছি বরং তুই শুরু কর। গায়ত্রী গাইতে শুরু করে, ‘কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে …
সত্যি গায়ত্রীকে আজ বাসন্তীরঙের শাড়িতে দারুণ দেখাচ্ছে, নিলা ভাবছে। ওদিকে সোমনাথের সঙ্গে আলাপরত রনবীর গায়ত্রীর কণ্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
‘কেন চাটগাঁ শহরে আর মেয়ে খুঁজে পাসনি, এতোদিন পর বউয়ের প্রতি আবার নতুন করে মায়া জাগলো কি করে?’ সোমনাথ বলে।
রনবীর হেসে বলে, কি যে বলিস না তুই।
মোবাইলফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রনবীর পাশে উপবিষ্ট মিলিকে বলে, বুঝলে মিলি, ইচ্ছা থাকলেও আমি কখনও গায়ত্রীর বাইরে অন্য কোনো নারীর সান্নিধ্যলাভ করিনি। জানো তো, আমার এই ভয়ংকর মুখশ্রী দেখলেই মেয়েরা আমার কাছ থেকে এক শ হাত দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করে। যা একটু-আধটু ঘটেছে, তা ওই হোটেলের সহজ-সরল, আলাভোলা দেহপসারিণীদের সাথেই ঘটেছে। রনবীরের সহজ-সরল স্বীকারক্তি শুনে মিলি হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে চায়ের পেয়ালা থেকে চা উপচে পড়ে।
দাদা, তুমি তো দেখছি একটা মহৎ মানুষ।
পাশে উপবিষ্ট ইমতিয়াজ ইকরাম বলে, ওকে তুমি মহৎ বলছো, ও একটা আস্ত শয়তান।
রনবীর হাসে। হাসি শেষ হতেই সে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করে, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ …। প্রতিবারের মতোই রনবীরের গান বাতাসে হারিয়ে যায়, কেউ কিছু বলার আগেই। রনবীর যেন সবার কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে ক্রমশ। তার ছবি, রঙ, সবকিছুই যেন ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে উঠছে কলকাতা-চাটগাঁ শহরে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে রনবীর হাঁটতে থাকে সোজা কোতোয়ালির উদ্দেশে।
যাক, মায়ের কাছে ফিরে যাই। অন্তত তার কাছেই কিছু ভালোবাসা আর পার্থিব উৎসাহ খুঁজে পাওয়া যাবে, রনবীর ভাবে।
(আগামী সংখ্যায়)