নিজস্ব প্রতিবেদক »
স্বামী পরিত্যক্ত আলেয়া বেগম (৫০) গত ২২ বছর ধরে সংসার বাঁচাতে যুদ্ধ করেছেন ঝড়-বৃষ্টি ও পরিবেশের সাথে। এরমধ্যে একমাত্র মেয়ে জেসমিন আক্তারকে বিয়েও দেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার স্বামী মারা যান। অসহায় হয়ে পড়েন আলেয়া। দু চোখে ঘিরে আসে অন্ধকার। উপায় না দেখে গ্রামের অনেকের কাছে থেকে ঋণও নেন তিনি। ঋণের টাকায় মা মেয়ের হাত কাজ করে সামান্য আয় করলেও সে আয়ের টাকায় কিস্তি পরিশোধ তো দূরের কথা দু বেলা দুমুঠো ভাতই জুটে না তাদের। এরমধ্যে নুয়ে পড়া ঘরটি মেরামত করার শক্তিটুকু তাদের ছিল না।
দুই মাস আগে হঠাৎ একদিন তাদের নুয়ে পড়া ঘর দেখতে আসেন পিএইচপি ফ্যামিলি ও পসকো ইন্টারন্যাশনালের লোকজন। তারা আশ্বাস দিলেন পাকা বাড়ি করে দেওয়ার। প্রথমে আলেয়া বেগমের বিশ্বাস হয়নি। পরে যখন তার পাওয়া ২ গন্ডা জমিতে ঘর তৈরির কাজ শুরু হয় তখন বিশ্বাস করেন তিনি পাকা বাড়ি পাবেন।
কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ৪ নম্বর চর ওয়াপদা ইউনিয়নের বাসিন্দা আলেয়া বেগম।
তিনি বলেন, মা মেয়ের কল্পনাতেও ছিল না, আমরা যে পাকা বাড়ি পাব। কেউ তো অসহায়ের দিকে ফিরেও তাকাই না। সেখানে পাকা বাড়ি তো স্বপ্ন। কথাগুলো বলতে বলতে আলেয়া বেগমের চোখে পানি চলে আসে। পাশে থাকা মেয়ে জেসমিন তাকে জড়িয়ে ধনে। পাকা বাড়ি পাওয়ার পরও কেন কান্না করছেন জানতে চাইলে হাসিমুখে আলেয়া বলেন, এটা আনন্দের কান্না। এই কান্নাতে সুখ আছে। সুখে পানি চলে এসেছে চোখে।
গত সোমবার দুপুরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান পসকো ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনের প্রচেষ্টায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ৪ নম্বর চর-ওয়াপদা ইউনিয়নের ১১ পাকা ঘর তৈরি করে হতদরিদ্র পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
উল্লেখ্য, পসকো-পিএইচপি ফ্যামিলি হতদরিদ্রের জন্য লোহা, কংক্রিট ও রঙিন ঢেউটিনের তৈরি ৬০০ বর্গফুটের ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। তিন কক্ষের প্রতিটি ঘরে দুটি শোবার কক্ষ, মাঝখানে একটি বসার কক্ষ, সামনে একটি বারান্দা এবং একটি বাথরুম রাখা হয়েছে। এই কাঠামোর বাইরে আছে একটি রান্নাঘর। নিজের জমি আছে কিন্তু দরিদ্র আর বাড়ি নির্মাণের সামর্থ্য নেই এমন পরিবারকে বেছে বেছে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণ করতে খরচ পড়েছে চার লাখ ৭০ হাজার টাকা। ঘর নির্মাণে পিএইচপি ফ্যামিলির তৈরি হওয়া রঙিন ঢেউটিন ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে গুণগত মান ও স্থায়িত্ব অক্ষুণœ থাকে। এর আগে গত ডিসেম্বরে একই এলাকায় ৫টি ঘর তৈরি করে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
পাকা বাড়ি পাওয়া চর-ওয়াপদা এলাকার হতদরিদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ (৪৫) বলেন, গাছ থেকে নারিকেল পারতে গিয়ে মেরুদ-ে আঘাত পান তিনি। এরপর থেকে তার কর্মক্ষমতা কমে আসে। এরপর থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করছিলেন তিনি। তার ঘরটি বন্যায় ভেঙে যায়। কোনমতে টিকে ছিল তার ঘর। এখন নতুন পাকা বাড়ি পেয়ে তিনি খুশি।
জ্যোৎসা বেগম (৫৫) নামের আরেক হতদরিদ্র বলেন, এই চরে সরকার থেকে ২ গন্ডা জমি বন্দোবস্তো পেয়েছিলাম। সেখানে তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করছি। আমি জায়নামাজ, পাটি বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। আর স্বামী এলাকার বিভিন্নজন থেকে ঋণ নিয়ে পলাতক। আমাদের খরচ দেন না। তবে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে বলে শুনেছি।
পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, পসকো’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আমি যৌথভাবে এলাকাটি পরিদর্শন করি ও সেখানকার মানুষের দূরবস্থা দেখে আমরা হতাশ হই এবং মানবিক বিবেচনায় চরের বাসিন্দাদের ক্রমান্বয়ে ঘর তৈরি করার মনস্থির করি। এখন পসকো’র সহযোগিতায় ১১ পাকা ঘর তৈরি করে বাসিন্দাদের বুঝিয়ে দিয়েছি। আমি ও আমার পিএইচপি ফ্যামিলি সৌভাগ্যবান ও আনন্দিত, চরের অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছি তার জন্য।
ইকবাল হোসেন বলেন, সরকারের একার পক্ষে সারা দেশে দরিদ্র জনগণের আবাসন নিশ্চিত করা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। তাই আমরা সরকারকে সহায়তা করতে এ উদ্যোগ নিয়েছি। পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সমাজের অসহায় মানুষকে সেবা করতে ভালোবাসেন। তারই ধারাবাহিকতায় সুবর্ণচরে হতদরিদ্রের জন্য ঘর তৈরি করে হস্তান্তর করেছি।
কোরিয়ার পসকো ইন্টারন্যাশনাল সদর দপ্তর থেকে বার্তায় মি. ড্যানিয়েল বলেন, আমরা আমাদের মূল্যবান এবং কৌশলগত অংশীদার পিএইচপি ফ্যামিলির সাথে এই কার্যক্রমটি চালিয়ে যেতে চাই এবং অদূর ভবিষ্যতে স্টিল হাউসের নতুন সরবরাহে আমাদের কার্যক্রমের স্তর উন্নত করতে চাই। যেসব পরিবারকে নতুন স্টিল হাউস হস্তান্তর করা হল তাদের ও তাদের পরিবারের সকলের প্রতি শুভকামনা রইলো। পিএইচপি ফ্যামিলির ইকবালের প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
পাকা বাড়ি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান পসকো ইন্টারন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সন চুল কিম, পসকো-বাংলাদেশের হেড অফ কমার্সিয়াল আহাসানুল আলম, সিনিয়র ম্যানেজার ডেনিয়াল লি, কান্ট্রি ম্যানেজার এস জে কং, নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির ( এনআরডিএস) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আব্দুল আউয়াল, সুবর্ণচরের ৪ নম্বর চর ওয়াপদা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান ভুইয়াসহ হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা।