রাজিব শর্মা »
চলতিবছর ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় স্বর্ণের চোরাচালান ধরা পড়ে। এ চালানে প্রায় ৪ কেজি ৫৪০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৬০ টাকা। পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের চারটি সিটের নিচে স্বর্ণগুলো রেখেছিলেন। বরাবরের মতো এ অভিযানে চালান ধরা পড়লেও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।
সীমান্ত ও বিমানবন্দর ঘিরে ক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সোনা চোরাচালান চক্র। মাঝেমধ্যে এসব চক্রের দুয়েকজন পাচারকারী ধরা পড়লেও বরাবরই অধরা রয়ে যাচ্ছে চক্রের সঙ্গে জড়িত মূল হোতারা।
একটি টিকেট কিংবা পাচারের সময় কিছু কমিশনের বিনিময়ে এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছেন যাত্রীরাও। এসব পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নগরীর হাজারিগলি, রেয়াজউদ্দিন বাজার ও খাতুনগঞ্জের একশ্রেণীর অসাধু স্বর্ণব্যবসায়ীর। বিমানযোগে পাচার হওয়া এসব স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাত ধরে কুমিল্লা ও ফেনীসহ দেশের অভ্যন্তরীণ সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার হয় ভারত ও দেশের অনান্য যায়গায়। এছাড়া সড়কপথের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে চট্টগ্রাম থেকে এসব পাচারের কাজে পাচারকারীরা বেশিরভাগ নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে রেলপথও। তবে সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে দুয়েকটা অভিযানে পাচারকারীরা ধরা পড়লেও, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে কিন্তু এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বড় বড় মূলহাতারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
পাচারকারীদের নানা কৌশল
জানা যায়, এসব স্বর্ণ চোরাচালানীরা পাচারের সময় নানা কৌশল ব্যবহার করে থাকেন। যার মধ্যে বিমানের সিট-টয়লেট, ল্যাগেজ, চার্জার লাইট, জুতা, ল্যাপটপ, মোবাইলের ভিতর, এমনকি যাত্রীর পেটের ভেতরে করেও পাচার করছে।
স্বর্ণ পাচারের বিষয়ে কাস্টমস সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অর্থ সংকট, অভাব, দারিদ্রতা, ও বেকারত্মের অভিশাপ কাটাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গমন করেন মানুষ। এসব দুর্বলতাকে টার্গেট করে তাদেরকে অর্থ, স্বস্তির কর্মস্থলসহ নানা লোভের ফাঁদে ফেলেন চক্রের সদস্যরা। এসব ফাঁদে পড়ে পাচারকারীরা নানা কৌশলে পাচার কাজে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মূল হোতাদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
অভ্যন্তরীণ এলাকায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট
সূত্রে জানা যায়, দুবাই, সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কুমিল্লা, ফেনী, ঢাকা, ঝিনাইদহসহ দেশের অভ্যন্তরীণ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এসব চক্রের বড় বড় সদস্যরা একদম রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর তাদের হয়ে কাজ করা পাচারকারীদের দেওয়া হয় টিকেট খরচ ও কিছু টাকা। সঠিক সময়ে স্বর্ণ চোরাচালান গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে দেওয়া হয় বখশিসের নামে চড়া অর্থ।
চালানে জড়িত রয়েছে বিমান বন্দরের কর্মীরাও
জানা যায়, প্রথমত পাচারকারি বিমান বন্দরে ঢুকার সময় চক্রের সদস্যরা হাতে ধরিয়ে দেন চালান ও অর্থ। ঐ চালান চেকিং করার সময় বিমান কতৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে রেখে আসেন। পরে সেখান থেকে বিমানের কর্মীরা নিয়ে আসেন বিমানে। একইভাবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে চালানটি এলে সিভিল অ্যাভিয়েশন, শুল্ক বিভাগ ও বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় চালানটি বন্দরের বাইরে বের করে আনা হয়। এ কাজের জন্য বিমান বন্দরের কর্মচারী থেকে উর্ধ্ধতন কর্মকতাদের দিতে হয় বড় অংকের ঘুষ। এরপর চুক্তিভিত্তিক কমিশনের সহায়তায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেন দেশে জড়িত থাকা চক্রের সদস্যরা। যদি উৎকোচের ভাগভাটোয়ারায় কোথাও গরমিল হয় তাহলে তা গোপনে জানিয়ে দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। তাই ধরা পড়ে ঐসব স্বর্ণের চোরাচালান।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. আল মাসুদ খান বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স শুধু যাত্রীবহন করে। কিন্তু স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হলে যারা চেকিং করে ঐসবস্থানে সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে।
এয়ার লাইন্সে কাজ করা কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বলেন, বিমান বন্দরে ২০ থেকে ৩০ টা সংস্থা কাজ করে। এখানে যে চুরি করে সে চুরিই করবে। তাকে তদন্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। স্বর্ণ চোরাচালানে কে বা কারা জড়িত তাদেরকে প্রকাশ্যে আনতে কাস্টমস ও অনান্য সংস্থার তদারকি কঠোর করতে হবে। সে যেই হোক, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।
গত এক দশকে সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান
এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা তথ্য মতে, গত এক দশকের মধ্যে শাহ আমানত আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে স্বর্ণের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ হয় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ। ওই চালানে জব্দ ৯০২টি স্বর্ণের বার। যেসব বারগুলোর মোট ওজন ছিল ১০৫ কেজি ২০০ গ্রাম। যার বাজার মূল্য ৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় বিমানের ১০ যাত্রীকে। একই মাসে পৃথক আরেকটি চালানে আরও ৬ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছিল। একই বছরে পুরো বছরজুড়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্বর্ণ জব্দ করা হয়। যার পরিমাণ ২৫৪ কেজি। পুরোবছরে গ্রেফতার হন ২৫ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩২টি চালানে ১০৩ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ২৩০ কেজি স্বর্ণের বার এবং সাড়ে ৬ কেজি স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করেন শুল্ক কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। যাদের মধ্যেই অধিকাংশই ছিলেন যাত্রীবেশে বহনকারী। কিন্তু এসব মামলার তদন্তেও চিহ্নিত করা যায়নি মূলহোতাদের।
২০১৯ সালের ৪ মার্চ নগরীর সিআরবি থেকে সিএমপির ডিবি পুলিশ এবং জেলার জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ পৃথক দু’টি চালানে ৭০০টি অবৈধ স্বর্ণের বার জব্দ করেন। এসব স্বর্ণের বাজারমূল্য ৩১ কোটি টাকা। স্বর্ণ জব্দের সময় গ্রেফতার হওয়া কালু ও রাকিব বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। এ ঘটনায় সিএমপির কোতোয়ালী ও জোরারগঞ্জ থানায় পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করা হয়।
তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৮টি অবৈধ চালানে প্রায় ২০ কেজি সোনা আটক করা হয়। যার বাজার মূল্য ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে এই বিমানবন্দর দিয়ে ১৮টি অবৈধ চালানে প্রায় ৭৮ কেজি সোনা আটক করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪১ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে চট্টগ্রামে অবৈধভাবে ১১টি চালানে প্রায় ৩৬ কেজি সোনা আটক করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে স্বর্ণের চাহিদা বছরে ১৬ থেকে ২৬ টন। কিন্তু এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি স্বর্ণ অবৈধ পথে দেশে আসছে। প্রতি পাঁচটি স্বর্ণের চালান এলে ধরা পড়ে মাত্র একটি।
এ বিষয়ে কাস্টম গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যখন তদন্ত করি তখন অনেক সময় দেখা যায় স্বর্ণ উদ্ধার হলো, কিন্তু চোরাচালানীরা আত্মগোপনে চলে গেলো। দুয়েকজন চোরাচালানী গ্রেফতার হলে তাদের আমরা পুলিশের কাছে সোপর্দ করি। এখন বিষয়টি তদন্ত করে চক্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।’
সোনা চোরাচালানে বিমানের কর্মকতা কিংবা কর্মচারীদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একজন বাহকের পক্ষে কখনো অল্প সময়ে বিমানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো চেনা সম্ভব নয়। তাছাড়া চোরাই স্বর্ণগুলো রাখার বিষয়টিও সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া অনেক অভিযানে বিমান বন্দরে থাকা কর্মীদের সম্পৃক্ততাও আমরা দেখতে পায়। এ বিষয়ে আমরা বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখন অপরাধ ঠেকাতে তাদেরও সর্তক হওয়া জরুরি।’
সিএমপির পশ্চিম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘শুধু পুলিশ নয়, বিমান বন্দরে কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। সবই যদি সমন্বয় করে তদারকি করেন তাহলে চোরাচালান চক্রের মূলহোতাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো উদ্যোগী হলে স্ব-স্ব দেশের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যৌথভাবেও টাস্কফোর্স গঠন করতে পারলে কিছুটা সুফল আসতে পারে।’