আকাশ ইকবাল
নাসির আল মামুনের লেখা ‘আহমদ ছফার সময়’ নামে বইটিতে একটি সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘একটা মানুষের মধ্যেই গোঁজামিল থাকে। কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পারসেন্ট সাপ। যে শেয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শেয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, শেয়ালও হইতে পারে, পাখিও হইতে পারে। মানুষেরই বিভিন্ন চরিত্র নেয়ার ক্ষমতা আছে। বুঝছো, গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শেয়াল পাওয়া যাইতো। এগুলা নাই এখন। কারণ সাপ, শেয়াল এরা মানুষ হিসাবে জন্মাইতে আরম্ভ করছে।’ বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রতিবাদী এবং প্রগতিশীল লেখক আহমদ ছফা। তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। আর কলম দিয়ে লেখা প্রতিটি শব্দ যেন এক-একটা বুলেট।
আহমদ ছফা ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ। তাই সহজে ছুঁয়ে গেছেন মানুষের হৃদয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, জাতির শিক্ষক ও জাতির দর্পণ হিসেবে আহমদ ছফাকে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। অনেকেই আহমদ ছফাকে প্রাবন্ধিক হিসেবে দেখলেও তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। একাধারে রাজনীতিক, কবি, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট কলামিস্ট।
বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক ও সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আহমদ ছফাই সবচেয়ে সাহসী, কুশলী ও বহুমাত্রিক। যে সত্য প্রকাশ করতে তাঁর সমকালীন অনেক বড় বড় লেখকও হিমশিম খেতেন, তিনি তা অসংকোচে অবলীলায় প্রকাশ করতেন। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলির জন্যও আহমদ ছফা ছিলেন অনন্য। সারা জীবন শুধু লেখা-লেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি। অনেকের সুখ-দুঃখের অংশীদারও হয়েছেন। বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন যেমন তেমননি সামর্থ অনুযায়ী সহায়তাও করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশের অনেক প্রখ্যাত লেখক তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। কারণ, তাঁরা তাঁর সহযোগিতা না পেলে হয়তো লেখকও হয়ে উঠতো না। এরকম উদাহরণ অনেক আছে। সবার কথা বলতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে। আজ শুধু চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কথাই বলবো। আমরা সবাই চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে চিনি। বেঁচে থাকতে তিনি আজকের মতো এতোটা জনপ্রিয়তা পাননি। আহমদ ছফা শিল্পী সুলতানের আঁকা ছবিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সেসময়কার ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য চিত্রশিল্পীরা হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে তাঁর পেছনে লেগে ছিলো। এই বিষয়টা খুব ভালোভাবে লক্ষ করেছিলেন আহমদ ছফা। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, সুলতানের পাশে দাঁড়াতেই হবে। পরবর্তীতে অনেক বাধা বিপত্তির পরেও আহমদ ছফা শিল্পী সুলতানের পাশে ছিলেন এবং সহযোগিতা করে গেছেন। আহমদ ছফা সুলতান ও তার শিল্পকে সবার নজরে আনার জন্য ৫০ পৃষ্ঠার গোটা একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন। প্রবন্ধটির নাম ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’। ওই প্রবন্ধটি সবার নজরে আসার কিছুদিনের মধ্যে সুলতানের খ্যাতি পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ততদিনে সুলতান আর বেঁচে ছিলেন না।
আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেছেন। করেছেন বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যজগতের অনুপ্রাণিত একজন স্রষ্টা। যার কর্মের মাধ্যমে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিত্রকারসহ অনেকে উৎসাহ পেয়েছেন প্রতিনিয়ত। যদি নাম বলা হয় তার মধ্যে অন্যতম আছেন হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকে। তাকে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী।
সলিমুল্লাহ খান আহমদ ছফাকে ‘গরীবের রবীন্দ্রনাথ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর প্রবন্ধে সলিমুল্লাহ খান লিখেন, ‘গ্যেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার জীবনে মহত্তম মানুষ, জীবনের সমস্ত সমস্যা-সংকটে আমি রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করেছি।’
পড়াশোনা চলাকালীন অবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি ন্যাপ বা তৎকালীন জনপ্রিয় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকা- ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে আহমদ ছফাকে। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে এবং পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুদিন আত্মগোপন করেন।
সত্যি কথা বলতে কি, আহমদ ছফার বিস্তৃতি অনেক। আমার এই ছোট্ট একটি নিবন্ধে পুরো বিস্তৃতি শেষ করা সম্ভব না। এরপরও যতটুকু সম্ভব তুলে ধরছি। আগামীর উদ্দেশ্যে। ষাটের দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন আহমদ ছফা। সমসাময়িক উপন্যাস লেখকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘সূর্য তুমি সাথী’, গাভী বিত্তান্ত’, ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’, ‘অলাতচক্র’ ‘মরণবিলাস’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ইশ্বরী’ ইত্যাদি।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রুত পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলে দেন তিনি। তার আরেকটি বেশ জনপ্রিয় উপন্যাস হলো ‘গাভী বিত্তান্ত’। উপন্যাসটিতে তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও শিক্ষকদের রাজনীতি প্রকাশ পেয়েছে বইটিতে। যে উপন্যাস সম্পর্কে বলতে হয় সেটি হলো ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’। তাঁর এই গ্রন্থটি জীবন সম্পর্কে তাঁর বোধ, প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ভাবনাসহ সকল কিছু একসঙ্গে গেঁথে দেয়।
আহমদ ছফার যে বিষয়টি একজন নতুন পাঠককে আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে রচনার সাবলীলতা। তিন তাঁর লেখনিতে মুক্তিযুদ্ধকে অনেকবার স্মরণ করেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত ‘অলাতচক্র’ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। এই উপন্যাসটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে তিনি প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন। এই উপন্যাসে শরণার্থী বিষয়ও উঠে এসেছে। ১৯৮৬ সালের দিকে এসে জার্মান ভাষার উপর গ্যেটে ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। গ্যেটের অমর সাহিত্য ‘ফাউস্ট’ অনুবাদের ক্ষেত্রে এটিই ছিল প্রথম সোপান।
আহমদ ছফার যে দুইটি উপন্যাসের কথা না বললেই নয়। আহমদ ছফা একদিকে লিখেছেন ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ আর অন্যদিকে লিখেছেন ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ উপন্যাস দুটি। ছফা যেখানে আলী কেনানকে অসাধারণ করে তুলেছেন তাঁর চরিত্রের মাধ্যমে অন্যদিকে আঘাত করেছেন ধর্ম ব্যবসার মূলকে। যারা মাজার পুজো করে এবং মাজার নিয়ে ব্যবসা করে। ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে মুসলমান যে আলাদা একটি জাতি ও গোত্র সেটা তিনি সেখানে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আহমদ ছফার লিখিত প্রবন্ধগুলো মূলত দুইভাগে ভাগ। একভাগ হচ্ছে রাজনীতি আরেকভাগ হচ্ছে অরাজনৈতিক। অরাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোতে তিনি দর্শন এবং বিভিন্ন শিল্পী এবং সামাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
তিনি সাহিত্যের নির্যাস নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। আর জ্ঞানের নির্যাস নিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক থেকে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছফার জীবনে বড় ভূমিকা রাখেন। যা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থটি পাঠ করলে স্পষ্টই বোঝা যায়।
আহমদ ছফা মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোর জন্য সেসময় আলেচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যকে অন্যমাত্রায় নিয়ে আসেন। তাঁর সাহসী কলমের কালিতে উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নির্মম সত্য।
জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠে’ লিখতেন আহমদ ছফা। গণকণ্ঠেই মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি এখনও বাংলাদেশে রাজনীতি সাহিত্যে অনবদ্য এক সৃষ্টি হিসেবে রয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ প্রবন্ধে তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সত্তুরের দশকে ছফার সেই খুঁজে পাওয়া সমস্যাগুলোর সাথে আজকের সমস্যা ও প্রাসঙ্গিকতা যে কেউ খুব সহজে মিলিয়ে নিতে পারেন। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি ১৯৯৬ সালে যখন ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’ গ্রন্থে সংযোজন সহ পুনর্মুদ্রিত হয় তখন তিনি দেখিয়ে দেন কিভাবে তাঁর করা রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সত্য হয়েছে।
তিনি বাংলা ভাষা নিয়েও একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। সেটি হচ্ছে ‘বাংলা ভাষা রাজনীতির আলোকে’। এই গ্রন্থটিতে ছফা বাংলাভাষার উপনিবেশায়ন নিয়ে বিস্তর আলাপ করেছেন।
কবি হিসেবেও আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর ‘প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’, ‘লেনিন ঘুমোবে এবার’ ‘জল্লাদ সময়’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো বেশ সাড়া জাগিয়েছে দেশে।
এছাড়া আহমদ ছফা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রচুর কলাম লিখেছেন। যেগুলোতে সমাজ, রাষ্ট্রের এবং মানুষের চিত্র ফুটে উঠেছে। সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।
আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। শুধু নাম বললেই ভুল হবে, বলা যায় বাতিঘর। তাঁর রচনাগুলো শুধু পাঠ করলেই হবে না, সাথে তাকেও বুঝতে হবে। আর তাকে বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে বাঙালি মুসলমান গোষ্ঠীকে।