সুপ্রভাত রিপোর্ট »
নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর এবং তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। সোমবার র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
র্যাব সূত্র জানায়, গত ২০ অক্টোবর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তর, গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৭ এর বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানা এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। এ সময় সমতল থেকে পাহাড়ে আত্মগোপনকৃত সাত জঙ্গি এবং তাদের সহায়তাকারী তিনজন কেএনএফ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ অক্টোবর গ্রেফতার সেই আসামিদের বিরুদ্ধে বিলাইছড়ি থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
গ্রেফতারকৃত সাত আসামির মধ্যে নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিক ছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, বিলাইছড়ি থানায় দায়ের করা সেই মামলার তদন্তকারী অফিসার আদালতে পাঁচজন আসামির রিমান্ড আবেদন করেন। পরে সংগঠনটির সামরিক শাখার উপ-প্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ ওরফে মানিকসহ পাঁচ আসামির ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর মারুফকে জিজ্ঞাসাবাদে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় র্যাব।
যেভাবে অভিযান ও গ্রেফতার
দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারের বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, র্যাব গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে, জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান রনবীর এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মো. আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প- ৭ এর এ ব্লকে ভোর ৫টা থেকে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-২, র্যাব-৩ এবং র্যাব-১৫ এর যৌথ চিরুনি অভিযান শুরু করে। র্যাবের অবস্থান বুঝতে পেরে জঙ্গিরা পাশের পাহাড়ে চলে যায়। র্যাব ওখানে অভিযান শুরু করলে সশস্ত্র লোকজন র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে দুই জঙ্গি নেতাকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় র্যাব।
জঙ্গি দলের পাহাড়ি যোগ
বার্তাসংস্থা বিডিনিউজ জানায়, বেশ কয়েকজন তরুণের ঘর ছাড়া তদন্তে নেমে ২০২২ সালের অক্টোবরে র্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার কথা জানায়।
র্যাব বলছে, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
এদিকে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে পাহাড়ের একটি সশস্ত্র দলের তৎপরতার খবর বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় আসছিল। পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হিসেবে তুলে ধরে।
এ সংগঠন ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চায়; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না; থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।
দুই দফায় জামাতুল আনসারের ১২ জনকে গ্রেফতারের পর র্যাবের তরফ থেকে বলা হয়, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে পাহাড়ের দল বম পার্টি পৃষ্ঠপোষকতা করছে। পাহাড়ে তাদের প্রশিক্ষণও চলছে।
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগের’ তথ্য সামনে আসার পর অক্টোবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত অভিযান শুরু করার কথা জানায় র্যাব; যার অংশ হিসেবে দুর্গম এলাকায় প্রচারপত্র বিলি, মাইকিংও শুরু হয়।
জঙ্গিদের অবস্থানের তথ্য প্রদানকারীকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ওই লিফলেট। পাশাপাশি জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় সেখানে।
এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতারের পর ২১ অক্টোবর র্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।
আর ২৭ অক্টোবর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি জানায়, জামাতুল আনসারের মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজ, যিনি রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক শিবির কর্মী।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান সেদিন বলেন, কেএনএফ বা বমপার্টির প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্যদিকে জামাতুল আনসারের বর্তমান আমীর শামিন মাহফুজ ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
‘জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যখন দুর্গম জায়গা খোঁজা হচ্ছিল তখন শামিন মাহফুজ জানতে পারে তার বন্ধুই বমপার্টির প্রধান। এরপরে তারা যোগাযোগ শুরু করে এবং কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে চুক্তি হয়।’
আসাদুজ্জামান সেদিন বলেন, ‘এ বছরের শুরুর দিকে পাহাড়ি ক্যাম্পে শামিন মাহফুজসহ কয়েকজন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, তাদের দলের নাম হবে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া’।’