স্বপন মজুমদার »
অমৃতবারি শুধু কথায় কি মেলে
চাতক স্বভাব না হলে : লালন সাঁই
ঘনবর্ষার জলছাড়া চাতক অন্য জলপান করে না। তার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে। চট্টগ্রামের লোকগান, আঞ্চলিক গান ও ভাবসংগীতের অন্যতম দিকপাল সৈয়দ মহিউদ্দিন। সাধকের সাহচর্য ছাড়া সাধক চেনা যায় না। তেমনি গত পঁচিশ বছরেরও অধিক সময় সৈয়দ মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে আছি। যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশ লেখক শিবির-এর কোনো এক অনুষ্ঠানে বিখ্যাত গণসংগীতশিল্পী আবসার ভাইকে তবলায় সংগত দিতে এসেছিলেন মহিভাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সেই নন্দিত গানে :
‘সুদূর সমুদ্দুর প্রশান্তের পারে হিরোশিমা
দ্বীপে আমি শঙ্খচিল …
বিভিন্ন তালের এই গানটিতে নিপুণ হাতে বাজালেন তিনি। সৈয়দ মহিউদ্দিন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের নেতা করিম আবদুল্লাহর বন্ধু হওয়াতে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। আলাপচারিতায় জেনেছি তিনি মাইজভান্ডারী তরিকায় দীক্ষাপ্রাপ্ত মানুষ। কঠিন মার্কসবাদী নেতার ভাববাদী বন্ধু এই মানুষটি আমাদের খুব ভাবাতেন। দীর্ঘ এই মার্কসবাদচর্চার পথ পরিক্রমায় অনেক নেতাকে হারিয়ে ফেললেও মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটি নিবিড় থেকে নিবিড় হয়েছে। বস্তু আর ভাবের গড়াগড়িতে মহিভাইয়ের কাছ থেকে পেয়ে গেলাম এক অসাধারণ গান :
‘দেহ ও প্রাণের ঝগড়াঝাটি
মীমাংসা করিবে কে?
মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে ভাবতে পারে সেই ভাবনাগুলোকে জড়ো করতে পারে। আর ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য মনস্থির বা লড়াই করতে পারে। এভাবে কাঠামোগত চিন্তা থেকে আমার সরে আসার পেছনের চিন্তাসূত্র হচ্ছেন মহিভাই, আমাদের সৈয়দ মহিউদ্দিন। জাগতিক জীবনের সমস্ত চাহিদাকে তিনি তুচ্ছ করেছেন। বস্তুবাদীর আশ্রয়ে থাকা মানুষটি তাঁদের সম্পর্কের মূল্যায়ন করেন প্রেম দিয়ে। শক্তির নিত্যতার অপর নাম হচ্ছে প্রেম। তিনি বলেন, লৌকিক দৃষ্টিতে কোনো বস্তুকে যা দেখা যায়, জ্ঞানদৃষ্টিতে তা ভিন্ন। আবার প্রেমদৃষ্টিতে সবকিছু অভিন্ন সত্তা। তিনি তাঁর সমস্ত জীবন ও সম্পর্ককে প্রেমদৃষ্টিতে দেখেন। সেই শিক্ষা পাওয়ার পর বুঝলাম, বস্তু যুগপৎ সসীম ও অসীম। এই অখ-তা কিংবা অসীমতাই বস্তুর স্বরূপ তথা প্রেম। শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসে যে অন্তহীন সমস্যা চলে আসছে, তার মূল কারণ হচ্ছে বস্তুর প্রতি আমাদের খ-িত দৃষ্টিভঙ্গি তথা বিচ্ছিন্নতাবোধ। আমরা আরোপিত চিন্তার কাঠামোকে যুক্তিবাদ দিয়ে সাজাই কিন্তু উপলব্ধি বা মুক্তপ্রাণের যে বোধ তাকে লুকিয়ে রাখি। মহিভাই সেখানে বলছেন, তুমি ডানা ঝাপটাও, ওপরের দিকে ওঠে যাও, আকাশের দিকের গুরুত্ব কমে যায়।
ডিসি হিলের এক অনুষ্ঠানে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকটা পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনি। দৃঢ় মনোদৈহিক ক্ষমতার বদৌলতে সৈয়দ মহিউদ্দিন আবার দাঁড়িয়ে যান। তিনি বলেন, মহাপ্রাকৃতিক ইচ্ছার সাথে নিজের ইচ্ছার সরল বৈশ্বিক মহাবিস্তারই হচ্ছে শান্তি। সুতরাং কোনো ঘটনা বা অঘটনের জন্য মন ভারাক্রান্ত হয় না। প্রকৃতির কাজে নিজের প্রয়োজন ফুরালে প্রকৃতি নিজেই আমাকে বিলীন করে দেবে। মানুষ যদি তার কর্ম ও প্রাপ্তিকে শনাক্ত করতে পারে, সেখানেই তার সাফল্য। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে তিনি মাইজভান্ডরীর দেউড়িতে গেয়ে উঠলেন :
আমার সকল ব্যবসা গুনাগারী যায়
এবার আমি দোকান দেব মাইজভান্ডারের কিনারায় …
মহিদর্শন : তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপকালে বুঝতে পারা যায়, সুফিদর্শনের ধারণার ভেতর দিয়েই তাঁর চিন্তাজগতের যাত্রা শুরু। তবে প্রাচ্যের সুফিধারণা বঙ্গে এসে নানা দিকে পাখা মেলে। জাতপাত বা বর্ণগত দ্বন্দ্বে এখানকার সুফি, বাউল-ফকিররা দেয়ালবন্দি মসজিদ বা মন্দিরে উপাসনাকে উপেক্ষা করেন। বৈদিক কিংবা শরিয়তি ধারার নিন্দা বা সমালোচনার ভেতর দিয়ে সুফি-বাউলদের দেহ বা মনুষ্যজাতির ওপর আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়।
প্রচলিত ধর্মকে অস্বীকার করে সমাজের মধ্যে আরেক সমাজ বানিয়ে তাঁরা বসবাস করেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ভাবচর্চা ও ভাব আন্দোলনের সূতিকাগার হলেও সপ্তদশ শতকে আমরা আরাকান রাজসভায় আলাওল, আলী রজাসহ অসংখ্য কবি-সাধকের মধ্যে নাথ-শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব ধারণার ভক্তিমূলক উপস্থিতি দেখি। আউল-বাউল-ফকির-দরবেশ-সুফি সকলের মধ্যেই ইন্দ্রিয় দমননীতির চর্চাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। মহিগুরুর মধ্যেও আমি মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে তুচ্ছ করার কর্ষিত সাধনা দেখতে পাই।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের গানের মৌলিকত্ব হচ্ছে : ভাবচর্চা নয়, ভাব আন্দোলন। আমাদের এখানে ফোক (ঋড়ষশ) কখনো-কখনো ঋধশব বা নকল হয়ে ওঠে। একে অন্যের গান থেকে ভাব-শব্দ সম্প্রসারণ করে আরেকটি গানের রচয়িতা হয়ে ওঠেন কেউ-কেউ। সেখানে মহিভাই একেবারেই স্বতন্ত্র। তাঁর গান ইহজাগতিকতাকে পরিহার করে পরাজগতে পাড়ি দেয় না। সমাজের বিদ্যমান সংঘর্ষ ও আত্মিক অসহায়ত্বকে তিনি তাঁর গীতিকবিতায় তুলে আনেন। যেমন :
‘আ-হায়রে গরু টানের গরুর গাড়ী
মুখুত্ ফেনা চগুত্ পানি
রাস্তা ধরি যারগৈ টানি
ফাঁত্ ফাঁত্ ফাঁত্ পিডুত্ পরের হাইল্লা ছোয়ার বারি
পিট্টান ফুলি দাগ্ দেখা র্যা আথারী পাতারি ॥
বিশ মইন্না গাড়ীত্ লইয়ে ষাইট মইন্না বোঝাই
টাইন্তে গরুর ঢাক ফাডি র্যা ত টানের কোঁথাই
এ্যান অমানুষ গাড়ীওয়ালা
ক্যানে বানাইল্ উঅরওয়ালা
কার কাছে তার বিচার দিউম্ কন্ডে কোড্ কাচারী ॥
ক্ষেত খামারত্ চাষত্ বাসত্ মাধান কে মাধান
আঁরার রিঝিক যোগাইবুল্লাই গরুর ক্যান্ কষ্টয়ান
মা’র বুগুর দুধ ফুয়ায় যদি
লেদা পোয়া বাঁচায় কিদি
এই বিরিষ বলদ গাইউর পোয়া খেয়াল গরি চাইত্ পারি ॥
ওরস মেজ্যান পাইল পরবত্ ছোয়াবর কামল্লাই
ফুলুর মালা গলাত্ গরি গরু জীবন র্দে কিল্লাই
যাত্তুন পাইর উপকার
হিথার উদ্ধি অইত্যাচার
আঁরা বলে সইভ্য মানুষ চাই থাকি চুপ মারি ॥
সাধু মহিভাই : ভালো মানুষ বা সৎমানুষ বলতে প্রচলিত ধারণার বাইরে আরেকটি মাানুষ থাকেন, যিনি কোনো বিশেষণের আকাক্সক্ষা না করেই কাজ করে যান। নিভৃতচারী এই মানুষগুলো শুধু কৈফিয়ত দিতে চান মহাকালের সামনে দাঁড়িয়ে। জাগতিক প্রাপ্তির বাইরে নিজের বস্তুগত আবির্ভাবের কারণ অনুসন্ধান করেন। তিনি বুঝতে চান :
‘আমি বা কার কেবা আমার
প্রাপ্তবস্তু ঠিক নাহি তার
বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকারÑ
উদয় হয় না দিনমণি … (লালন সাঁই)
যুগে-যুগে প্রবল আত্মজিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমেই মানুষের সামাজিক সম্পর্কের উন্নততর ভিত তৈরি হয়েছে। মহিভাই বলেন, নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যদি সঠিক হয়, তাহলে অন্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাও সেরূপ হবে। অর্থাৎ আত্মবোধে নিজেকে জানতে পারলে জীবজগতের সাথেও তা প্রেমবোধ আচরণে পরিণত হবে। কারণ, মানুষ নিজেকে ভীষণ ভালোবাসে। কোনো বিশ্বাসের দাসত্ব মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। মানুষকে মুক্তি দিতে পারে শুধু প্রেম। প্রেমবোধ মানুষকে নিঃস্ব হয়ে বিশ্ব হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আত্মআবিষ্কারের মাধ্যমেই মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আত্মদর্শনের সুরকেই তিনি মরমিয়া বলেন। তিনি বলেন, মরমি না-হলে মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে না। আর অসুন্দর মানুষেরাই এই সমাজকে খুব বিরক্ত করে। ‘দৈব আলো’ বা ‘আলোকিত মানুষ’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্ধকারে মানুষের জন্ম হয়। জন্মের পরে চোখ ফুটলেই চোখের আলোজ্ঞান হয়। কিন্তু অন্ধ মানুষের চোখ তো আলো দেখে না। তাহলে কি সে অনালোকিত মানুষ? মোটেই তা নয়। বোধের উপলব্ধি বা দেখার উপলব্ধিই শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়জ্ঞান নয়। মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে সত্য সেতুবন্ধন গড়ে তোলার যে চেষ্টা চালায়, সেই চেষ্টায় সার্থক মানুষকেই আমরা আলোকিত মানুষ বলি। সূর্য সাম্যজ্ঞানে সবাইকে আলো দেয় আর কিছু মানুষ সূর্য থেকে আলো ছিনিয়ে নেয়। আমরা তা বুঝে সেই মানুষটির কাছে যাই আরো কিছু আলো নিতে। তিনিই হচ্ছেন ‘গুরু’ যিনি দৈব আলো ধারণ করেন।
সৈয়দ মহিউদ্দিন নারী-পুরুষকে ‘যুগল’ হিসেবে দেখেন : প্রচলিত বৈবাহিক জীবনে তিনি যাননি। শর্তারোপিত সম্পর্ক মানুষকে মুক্ত করে না। বরং শর্তকে লুকিয়ে চলে লুকোচুরি। ‘প্রেম’ কখনও আগ্রাসন বা চাপিয়ে দেয়া বা প্রতিহিংসা বা নিজস্ব প্রত্যাশার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে না। এ হচ্ছে সুর আর তালের মতো। একজন অপরজনকে অনুসরণ করে। শুনতে হবে কান পেতে। তিনি বলেন, যার কান নেই, তার গান নেই। দুজনকে মরমে মরতে হয়। সেই আত্মসম্পর্কের ব্রত নিয়েই যুগলবন্দি হয়। সেখানে লিঙ্গচেতনা লুপ্ত হয়ে মনোদৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়।
যুগলের মনোমালিন্য প্রশ্নে তিনি বলেন, মনোমালিন্য হতেই পারে। তবে তারা যেহেতু সুর আর তালে বাঁধা, সেখানে সুর যদি পড়ে যায়Ñ তাল তাকে টেনে তোলে। কখনো তাল যদি বেতালে যায়, সুর তাকে গতি দেয়। বেসুরো মানুষ হচ্ছে অসুর। যে তছনছ করে সুন্দরকে। এবড়োখেবড়ো করে দেয় ছন্দোময় কবিতার বর্ণমালা। ভালোবাসা বা প্রেম দখল করার বিষয় নয়। যেমন জমি দখল করা যায়। কিন্তু কর্ষণ না জানলে তাতে উর্বরতা আসে না। শস্য ফলে না। শুধু দখল করে থাকার মর্জি মানে জমিকে বিরান করে দেয়া।