ভূঁইয়া নজরুল »
সাগরে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) পরিবহন। একজাহাজ থেকে আরেক জাহাজে এলপিজি স্থানান্তরে নিরাপত্তামূলক যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা, তা না থাকায় শঙ্কা বাড়াচ্ছে এলপিজি। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাখতে হয় টাগবোট ও ফেন্ডার (বয়ার মতো প্লাস্টিকের স্থাপনা যা পানিতে ভেসে থাকে) এবং আশপাশে কোনো জাহাজ না থাকাটাও জরুরি।
এলপিজি আমদানির সাথে জড়িত অনেক আমদানিকারক লেবাননের রাজধানী বৈরুত বন্দরের বিস্ফোরণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাদের মতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে এলপিজি স্থানান্তর করা হলে বৈরুত বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। গত বছরের আগস্টে বৈরুত বন্দরে জমে থাকা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরিত হয়েছিল এবং যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পারমানবিক বোমার পর সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ।
এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠনের একাধিক সদস্য জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে এলপিগ্যাস স্থানান্তর হচ্ছে। কিন্তু এই স্থানান্তরের সময় পানির ঢেউয়ের ঝাঁকুনিতে যাতে জাহাজের লেবেল ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ না হয় সেজন্য টাগবোট ব্যবহার করতে হয়। একইসাথে দুই জাহাজের মাঝখানে আবার ফেন্ডার (বয়ার মতো প্লাস্টিকের স্থাপনা যা পানিতে ভেসে থাকে) দিতে হয়। এছাড়া এলপিগ্যাস স্থানান্তরের সময় আশপাশে কোনো জাহাজ থাকতে পারবেনা।
এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মোহাম্মদ তোফাজ্জ্বল হোসেন বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী যারা এসব পণ্য যারা পরিবাহিত করবে তারাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। যদি তারা না করে তাহলে এর দায়ভার সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে মারাত্মক হতে পারে।’
দেশে এপর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস আমদানির জন্য অনুমোদিত। এসব প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনার কারণে এলপি গ্যাস খাত দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করছে। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী, এলপি গ্যাসবাহী জাহাজের কমপক্ষে ৪০ মিটারের মধ্যে অন্য কোনো জাহাজ থাকতে পারবে না। একইসাথে সাগরের ঢেউয়ে যাতে জাহাজ দুটির মধ্যে সংঘর্ষ না হয় সেজন্য টাগবোট বা ফেন্ডার ব্যবহার করতে হয়। তবে মাদারভেসেল থেকে ছোটো জাহাজে স্থানান্তরের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হলেও ছোটো আকৃতির এক জাহাজ থেকে অপর জাহাজে স্থানান্তরে তা নেয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও শিপিং এজেন্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের কুতুবদিয়ায় অবস্থান করা মাদারভেসেল (৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিকটন এলপিজি গ্যাস নিয়ে আসার জাহাজ) থেকে ছোটো জাহাজে ( তিন থেকে ৩৫০০ টন ধারণ ক্ষমতার) স্থানান্তর করা হয়। সেই জাহাজগুলো সীতাকুণ্ড ও মংলায় এলপিজি প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় বহির্নোঙরে এক ছোটো জাহাজ থেকে আরেক ছোটো জাহাজেও এলপিজি স্থানান্তর করা হয়। আর তা করতে গিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলপিজি কোথায় স্থানান্তর করছে তা বন্দরকে অবহিত করা হয় না। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষও কিছু জানেনা। একইসাথে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও কিছু জানেনা। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে এলপিগ্যাসের স্থানান্তর।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘সাগরে জাহাজ থেকে জাহাজে এলপিজি স্থানান্তরে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে আমি শুনেছি। তা জানার পরপরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছি। একইসাথে ঢেউয়ের মধ্যে জাহাজ থেকে জাহাজে এলপিজি স্থানান্তর যাতে না করা হয় তাও বলে দেয়া হয়েছে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কপোরেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জাহাজ থেকে জাহাজে এলপিজি স্থানান্তরে অবশ্যই ফেন্ডার ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় ছোটো জাহাজটি যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে কিংবা দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এই পদ্ধতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে এলপি গ্যাস আমদানি ও প্ল্যান্ট নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া ইউরোগ্যাজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তুফান বলেন, ‘জাহাজ থেকে জাহাজে এলপি গ্যাস স্থানান্তরে এখনো কোনো নীতিমালা হয়নি। নীতিমালা হলে হয়তো তা ঠিক হয়ে যাবে। তবে জাহাজ থেকে জাহাজে এলপি গ্যাস স্থানান্তর অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা এখনো আধুনিক প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হতে পারিনি। বিপরীত দিকে আমাদের বঙ্গোপসাগরে অন্য সাগরের তুলনায় একটু ঢেউ বেশি।’
উল্লেখ্য, দেশে গ্যাসের সংকটের কারণে সরকারের অনুমোদন নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে এলপিজি আমদানি হচ্ছে। বছরে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিকটন এলপি গ্যাস আমদানি হয়। সাধারণত দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৫ থেকে ৬ হাজার মেট্রিকটন ধারণক্ষমতার জাহাজে করে এলপি গ্যাস সরাসরি সীতাকুণ্ড ও মোংলার প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে জাহাজ থেকে পাইপের মাধ্যমে সরাসরি প্ল্যান্টে প্রবেশ করানো হয়। বছরে প্রায় ৭০টি জাহাজ গ্যাস সরবরাহের কাজ করে। তবে গত বছর থেকে দুটি মাদারভেসেল একসাথে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন করে এলপিগ্যাস আমদানি করছে। দেশে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় এই সিলিন্ডার (এলপিজি) গ্যাসই এখন প্রধান সহায়।