সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলার পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া নাবিকরা যখন নিরাপদে দেশে ফিরলেন, ওই হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ তখনও যুদ্ধের ময়দান ইউক্রেনে।
মা রাশিদা বেগম জানেন না, কখন পাবেন ছেলের লাশ; শেষবারের মতো দেখে চিরবিদায় দেবেন প্রিয় সন্তানকে।
বুধবার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্য নাবিকদের গ্রহণ করতে স্বজনরা যখন এলেন আনন্দ নিয়ে, তখন রাশিদারা কেবল জানতে চাচ্ছিলেন, হাদিসুরের মরদেহ কবে মিলবে?
বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন রাশিদা; বলছিলেন, ‘সবাই আইছে, আমার ছেলে কই?’
ইউক্রেনে যুদ্ধের মধ্যে ওলভিয়া বন্দরে আটকে থাকাবস্থায় ২ মার্চ রকেট হামলার মুখে পড়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’। হামলায় নিহত হন ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর।
আতঙ্ক ও ক্ষোভের মধ্যে পরদিন ৩ মার্চ জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নাবিকদের বাংলার সমৃদ্ধি থেকে নামিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে একটি শেল্টার হাউজের বাংকারে ঠাঁই নেয় নাবিকরা। পরে মলদোভা হয়ে তারা পৌঁছান রোমানিয়ায়। সেখান থেকে বিমানে দেশে ফেরেন এই জাহাজিরা।
তাদের ঢাকায় পৌঁছার খবর শুনে দুপুরে বিমানবন্দরের ভিআইপি ফটকের সামনে উপস্থিত হন নিহত হাদিসুরের পরিবারের সদস্যরাও।
দুপুর ১টার দিকে ওই ফটকে হঠাৎ করে এসে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বিলাপ করতে থাকেন হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স।
‘আমার ভাই কই, আমার ভাই কই,’ ‘ভাই, ও আমার ভাই’ বলে বলে যখন তিনি মাতম করছিলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত কেউ বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোন নাবিকের স্বজন তিনি।
সাংবাদিকরা জানতে চাইলে নিজের পরিচয় দিয়ে তখনও বিলাপ করছিলেন, কিছু সময় পরপর মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বলতে থাকেন, ’ভাইরে ভাই আয় তুই আমার ভাই কই। সবাই আসছে আমার ভাই কই?’
ঢাকার কবি নজরুল কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী প্রিন্স আরও বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই মরতে পারে না। আমার ভাইয়ের লাশ চাই।’
কিছুদূর গিয়ে দেখা মেলে হাদিসুরের মা রাশিদা বেগম আর বাবা আব্দুর রাজ্জাকের মাস্টারের সঙ্গে। বিমানবন্দরে ছিলেন হাদিসুরের আরেক ভাই তারিকুল ইসলামও।
বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বিলাপ করতে থাকেন হাদিসুরের মা রাশিদা। মাতম করতে করতে আকুতি জানান ছেলেকে ফেরানোর।
এক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে মাতম করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন হাদিসুরের বাবা রাজ্জাক মাস্টারও।
বরগুনার অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক রাজ্জাকের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে হাদিসুর ছিলেন মেজ। জাহাজে চাকরির সুবাদে বছরের একটি বড় সময় থাকতে হত বাইরে। সবশেষ বাড়ি এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে কথা হত নিয়মিত।
রাজ্জাক বলেন, ‘কীভাবে কী হয়েছে জানতে আসছি। কীভাবে মারা গেল আমার ছেলে, অন্যদের কাছ থেকে জানতে আসছি। আমার ছেলেকে কখন পাব, সেটার কিছু পাই কি-না, দেখতে আসছি।’
কবে নাগাদ মরদেহ আসতে পারে, সে বিষয়ে সরকার বা শিপিং করপোরেশেনের কারও সঙ্গে কথা হয়েছে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের সাথে কেউ কথা বলেনি। পত্রিকা-টেলিভিশনে দেখছি, ৭-৮দিন নাকি লাগবে।’
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন দুদিন আগে বলেছিলেন, হাদিসুরের লাশ ইউক্রেন থেকে আসতে কিছু সময় লাগবে।
মরদেহ দ্রুত ফেরানোর চেষ্টার কথা বুধবারও বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব-ইউরোপ উইংয়ের মহাপরিচালক সিকদার বদিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাই হাদিসুরের লাশ ওখানে আছে। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমরা আবারও সহমর্মিতা জানাচ্ছি। এবং তার দেহাবশেষ আমরা অতিসত্বর দেশে আনতে পারব।’
হাদিসুরের লাশ ফেরানোর বিষয়ে পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
হাদিসুরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপাতত তাদেরকে ফিরিয়ে আনা, তারপর তাদের পরিবারের জন্য যা কিছু করণীয়, সেটি আমরা অবশ্যই করব।’
হাদিসুরের লাশ ফেরানোর বিষয়ে বদিরুজ্জামান বলেন, ‘এটা টাইম ফিক্সড করা দুরূহ একটা ব্যাপার। আপনারা সেটা ভিজুয়ালাইজ করতে পারছেন। একটা যুদ্ধ, সেখানে মানুষ ঢুকতে পারছে না, আসতে পারছে না।’
সাংবাদিকরা যখন জাহাজের মাস্টার নূর ই আলম আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার সাথে কথা বলছিলেন, তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে নিজেদের খবরটি শোনার চেষ্টা করছিলেন রাশিদারা।
হাদিসুরের বেঁচে ফেরা সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ছেলের খোঁজ নেওয়ার মনোবাসনার কথা জানালেও সেই সুযোগ মেলেনি রাজ্জাক মাস্টারদের।
বিমানবন্দরের আরেক ফটক দিয়ে বেরিয়ে হাদিসুরের সহকর্মীরা যখন বিমানবন্দর ছাড়ছিলেন, তখন আর খোঁজ নেওয়ার ফুরসৎ পাননি হাদিসুরের পরিবারের সদস্যরা।