ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম »
আজ ১৮ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে বেগম মুজিবকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রাথমিক বৌদ্ধিক লেখাগুলি মূলত গণিত নিয়েই ছিল। তিনি যে তত্ত্বটি রক্ষা করেছিলেন তার মতে, সমস্ত গাণিতিক জ্ঞানকে যৌক্তিক নীতির আকারে হ্রাস করা যেতে পারে। তবে রাসেল একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছিলেন: রূপকবিদ্যা, ভাষার দর্শন, নৈতিকতা, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব। ১৯৫০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের সেরা উক্তির মধ্যে – সত্যবাদী হও, এমনকি যদি সত্যটি অপ্রীতিকর হয় তারপরও; কারণ সত্য প্রকাশ করার চেয়ে সত্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টাটি আরো বেশি অপ্রীতিকর। বেগম মুজিব রাসেলের দর্শন আর তার জ্ঞান শুনে শুনে এতো ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাখেন রাসেল।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল ছিলেন সবার আদরের, সকলের স্নেহের। ঢাকার ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল শেখ রাসেল। মেধাবী রাসেলের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে। দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা শিশু রাসেলের স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দেয়। তাইতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণে বলেন, ‘আমার ১০ বছরের ছোট্ট ভাই রাসেল, তার জীবনের স্বপ্ন ছিল বড় হলে সে আর্মিতে যোগ দেবে। কিন্তু তার সে স্বপ্নপূরণ হয়নি। আমার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেটের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বঙ্গবন্ধুর এই শিশুপুত্র শেখ রাসেল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নরপিশাচরা নিষ্ঠুরভাবে শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করে। পিতা, মাতা, চাচা, ভাই-ভাবীকে শিশু রাসেলের চোখের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মায়ের কাছে নিয়ে যাবার নাম করে নরপিশাচরা তাকেও গুলি করে হত্যা করে। সেদিন শিশু রাসেল বাবা বঙ্গবন্ধু মুজিব এবং মা বেগম মুজিবের সাথে দোতলার একটি রুমে ঘুমিয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের ছেলে আবদুর রহমান শেখ উরফে রমার বর্ণনায়, ‘আর্মিরা শেখ নাসের, রাসেল ও আমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেখানে সাদা পোশাকে এক পুলিশের লাশ দেখতে পাই। নিচে শেখ নাসেরকে লক্ষ্য করে আর্মিরা জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? পরিচয় দিয়ে তাঁকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরে গুলির শব্দ ও ‘মাগো’ বলে চিৎকার শুনতে পাই। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল মার কাছে যাবে বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছিল, ভাই আমাকে মারবে না তো? এ সময় এক আর্মি শেখ রাসেলকে বলে, চল তোমার মার কাছে নিয়ে যাই। তাকেও দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই আর্তচিৎকার ও গুলির শব্দ শুনতে পাই। পরে জানা গেছে, মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঘৃণ্য খুনীরা শেখ রাসেলের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
ছোটবেলায় অন্য আট দশটা শিশুর মতোই শেখ রাসেল ছিল চঞ্চল প্রকৃতির। ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটি আনন্দময় করে রাখতো শেখ রাসেল। ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়। খুব দুষ্ট প্রকৃতির রাসেলের কথা তার শিক্ষিকাকে শুনতে হতো, নইলে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতো না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলকে আদর করে সে অনুযায়ী শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকার খাবার দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল শেখ রাসেল। প্রত্যেক দিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকতো এবং শিক্ষিকাকে তা খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও খুবই আদরের ছিল শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর লেখা কারাগারের রোজনামচা বইয়ে অন্তত ১৫টি জায়গায় রয়েছে রাসেলকে নিয়ে বাবা বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী বিবরণে এই লেখার প্রতিটি ছত্রে ফুটে ওঠেছে কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া শেখ রাসেলের স্মৃতি। শেখ রাসেল কারাগারকে মনে করতেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। যেমন ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের ঘটনা। ওইদিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকা ১৮ মাস বয়সী রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করেছেন। সেদিনের সাক্ষাতের প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে, আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম, দূর থেকে পূর্বের মতো ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিলো। ওরা বললো, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.৯৩) একইভাবে ১৯৬৬ সালের ১২ জুলাই তারিখে ঢাকায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে শেখ রাসেলের কথা এসেছে। ওই দিনের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “…. বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলে গেটে দাঁড়াইয়া ওদের বিদায় দিলাম। গেট পার হলেও রাসেল হাত তুলে আমার কাছে থেকে বিদায় নিলো। বোধ হয় বুঝে গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর এখানেই থাকবে!” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.১৫৯) অনেকদিন পর পিতাপুত্রের সাক্ষাৎ হলে পুত্র যেমন আনন্দাতিশয্যে শত অভাব অভিযোগ তুলে ধরে। শেখ রাসেলও ঠিক তাই করতেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সেই শিশুসুলভের পরিচয় দিতেন। ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাইয়ের এমনি এক বিবরণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- “….. তাড়াতড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরনো দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে। আমাকে দেখে বলছে, ‘আব্বা!’ আমি যেতেই কোলে এলো। কে কে মেরেছে নালিশ হলো। খরগোশ কীভাবে মারা গেছে, কীভাবে দাঁড়াইয়া থাকে দেখালো।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৪৯)
১৯৭২ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সংখ্যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে শেখ জামাল ‘ আমার বাবার কথা’ শিরোনামে টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই হৃদয়গ্রাহী রচনা থেকে জানা যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেলকে কতটা আদর করতেন। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক কথোপকথনের সূত্র ধরে শেখ জামাল লিখেছেন- ‘ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমার কথা শোনে। কিন্তু একজন মাত্র তা অমান্য করে। ঘরোয়া পরিবেশে কথাটি শেষ করেই গম্ভীর হতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘরে ছিলাম আমরা মা ভাই বোন ও জনাকয়েক আত্মীয় স্বজন। কথা শুনে সবাই অবাক। আশ্চর্য হয়ে তাকালাম বাবার দিকে। তারপর বাবার আবার প্রশ্ন, চেনো সেই লোকটিকে? অদূরে দাঁড়ানো আমার ছোট ভাই সাত বছরের রাসেলকে দেখিয়ে বাবা বললেন, ওই যে দুষ্টু ছেলেটি, ও একমাত্র আমার কথা অমান্য করে। ঘর ভরতি আমরা সবাই বাবার কথা শুনে হেসে উঠলাম। প্রাণখোলা হাসি হাসলেন বাবাও। এমনিতর অনেক হাসি ঠাট্টা আর ঘরোয়া গল্পে বাবা আমাদের প্রায়ই আনন্দ দেন।’
১৯৭৫-এর পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতেই বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা শেখ রাসেলকে হত্যা করে। কি নির্মমতা। খুনীদের কি পৈশাচিকতা। ৭৫ এর আগস্টের খুনীদের হাত থেকে শিশুপুত্র রাসেলও রেহাই পেলে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন তার শিশুরক্ত কবিতা। যেখানে কবিতায় কবি তুলে ধরলেন ইতিহাস –
রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দুদিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়
বয়স্করা এমনই উন্মাদ!
তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়েসেন্তে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচী হলো
শিশুরক্তপানে গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।
শহীদ শেখ রাসেলের স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৮ অক্টোবর পালিত হয় শেখ রাসেল দিবস। দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘শেখ রাসেল আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আছে তাঁর পবিত্র স্মৃতি। বাংলাদেশে সকল শিশুর মধ্যে আজও আমি রাসেলকে খুঁজে ফিরি। এই শিশুদের রাসেলের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। এমন এক উজ্জ্বল শিশুর সত্তা বুকে ধারণ করে বাংলাদেশের শিশুরা বড় হোক। খুনীদের বিরুদ্ধে তারা তীব্র ঘৃণা বর্ষণ করুক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে দেশের সকল শিশু এগিয়ে আসুক।’ আজ শেখ রাসেল বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষদের কাছে ভালবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তির্ণ জনপদ- লোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত। মানবিক চেতনা সম্পন্ন মানুষরা শেখ রাসেলের বিয়োগ দুঃখ বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৬০ তম জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।