নিজস্ব প্রতিনিধি, নাইক্ষ্যংছড়ি »
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলির পর সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত বুধবার সংঘর্ষের সময় শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শত শত ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই শূন্যরেখা ছেড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে।
জানা গেছে, তাদের বড় অংশই তুমব্রু, কোনারপাড়াসহ আশপাশের গ্রামে অবস্থান নিয়েছে। আবার অনেকে উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে প্রবেশ করেছে গোপনে।
গাছ ও বাঁশ নিয়ে ত্রিপল টানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করছিল রোহিঙ্গাদের আরও কয়েকটি পরিবার। অনেকে আবার আশ্রয়ের একটু জায়গার জন্য বোচকা- পোটলা নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে। এছাড়াও স্থানীয় বাজারেও অন্যদিনের তুলনায় রোহিঙ্গাদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
করিম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারীদের মধ্য আমিও ছিলাম। কিন্তু আগুন দিয়ে আমাদের ঘরবাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ, পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে একটি জায়গা খুঁজছি।
নাসের নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমরা শূন্যরেখায় (জিরো পয়েন্টে) ছিলাম। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আমাদের ঘরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন আমরা মিয়ানমারে ঢুকে যাই। এক রাত থাকার পর আবার বার্মা (মিয়ানমার) থেকে এপারে পার করে দিয়েছে সেই দেশের সরকার। এখন আমরা কোথায় যাবো?
তুমব্রুর বাজারের এক দোকানদার জানান, ‘গত বুধবার থেকে সীমান্তে থেমে গোলগুলি-আগুন খেলা চলছে। গতকাল ভোরেও গোলাগুলি-আগুনের ধোঁয়া দেখা গেছে। শূন্যরেখার অনেক রোহিঙ্গা তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তার আশপাশে এখন নতুন করে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। যার কারণে স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ‘শূন্যরেখায় গোলাগুলি ও ঘরে আগুন দেওয়ার কারণে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তবে কতজন রোহিঙ্গা এসেছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যেহেতু শূন্যরেখার ঘটনা, তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেখানে আমাদের হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই।’
গত বুধবার সকাল ছয়টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া শূন্যরেখায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষ ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা ক্যাম্পের বাড়িঘরে আগুন দেয়। এতে অন্তত ৫শ ঘর পুড়ে গেছে বলে দাবি করছে ওই ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।
বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহতের সঠিক তথ্য জানাতে পারছে না কেউ।
তবে ওইদিন দুপুরে উখিয়া থানা-পুলিশ একজন আরএসও সদস্যের লাশ উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ এক শিশু উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে এবং একজন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শূন্যরেখায় বসবাসরত রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা দিল মোহাম্মদ জানিয়েছেন, তাদের ক্যাম্পে ৬২১ পরিবার বাস করত। আগুনে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্যাম্পের বেশির ভাগ পরিবার মিয়ানমারে এবং কিছু পরিবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়েছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বাংলাদেশে ঠিক কতজন রোহিঙ্গা নতুন করে প্রবেশ করেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে সে তথ্য এখনো জানায়নি সরকারের কোনো সংস্থা। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। তাদের পুশব্যাক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। তবে সীমান্তের পাড়াগুলোতে চরম আতঙ্ক রয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে স্থানীয়রা যেন না যায়, তার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্তত আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে ৩৩টি ক্যাম্পে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট কমিটির (আইসিআরসি) তথ্যমতে, শূন্যরেখার ক্যাম্পটিতে ৬৩০টি ঘরে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করত।