নিজস্ব প্রতিবেদক »
সিলগালা করা হয়েছে নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকার শিশু পার্ক। ইজারা বাতিল করে পার্কের জায়গাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরকে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে জায়গাটি উন্মুক্ত রেখে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণে শিখা অনির্বাণ করতে চায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু এমং মারমা মং ও রাকিবুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অভিযানে শিশুপার্কটি সিলগালা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু এমং মারমা মং বলেন, ‘এ জায়গাটি মূলত সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের। জায়গাটি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্ব নেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। কিন্তু সিটি করপোরেশন জায়গাটি ব্যবস্থাপনায় ব্যত্যয় করায় আমরা ওখানে গড়ে ওঠা স্থাপনাটি সিলগালা করি। জায়গাটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের নির্বাহী অফিসার সাজিয়া তাহেরকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
জায়গাটি ব্যবস্থাপনায় কি ব্যত্যয় ঘটেছে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের সম্পত্তি সরকার চাইলে যে কোনো মুর্হূতে বুঝে নিতে পারে। কিন্তু ওখানে কি ধরনের ব্যত্যয় ঘটেছে তা ঠিক বলতে পারছি না। কারণ আমরা এই ইস্যুতে কোনো চিঠি পাইনি। আমাদের কাছে কোনো চিঠি পাঠালে, বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে পারতাম।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সামরিক ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা শারমিন আলম বলেন, ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে খেলার মাঠ কিংবা উন্মুক্ত পার্ক করার জন্য জায়গাটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু সংস্থা জায়গাটি তৃতীয় একটি পক্ষকে লিজ (ইজারা) দেয়। যা শর্ত ভঙ্গ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। মূলত জায়গাটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে তাদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দখল বুঝে নেওয়া হয়েছে।’
জায়গাটিতে কোনো কিছু করার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জায়গাটি দখল আমরা বুঝে নিয়েছি। জেলা প্রশাসক স্যারের পরামর্শে কি করা হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তবে সেনানিবাসের পক্ষ থেকে কিছু করার কোনো পরিকল্পনা নেই।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয় সার্কিট হাউসে। এ সার্কিট হাউসে মুক্তিযোদ্ধাদের ইলেকট্রিক চেয়ারে নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসর্মপণ করে এ জায়গাটিতে। এখানেই শুরু হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা। ইতোপূর্বে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সার্কিট হাউস সংলগ্ন বাণিজ্যিক শিশু পার্কটি বন্ধ করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সবুজ চত্বর তৈরির দাবিতে মানববন্ধন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
এ প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি যখন জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাদের বিজয়মেলা কার্যক্রম সহ্য হচ্ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ইন্ধনে বিএনপির তৎকালীন মেয়র মীর নাছির উদ্দিন বিজয় মঞ্চের আলোচনা বন্ধ করার জন্য উন্মুক্ত এ জায়গাটিকে ২৫ বছরের জন্য লিজ নিয়ে শিশুপার্ক গড়ে তোলেন। আজকে (সোমবার) জেলা প্রশাসনের এ সাহসী উদ্যোগে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা চাই, জায়গাটি খোলা রেখে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কিছু করা হোক।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ বলেন, ‘এটা শুরু থেকে আমাদের দাবি ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা থেকে এ শিশুপার্ক অপসারণের জন্য যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের অনেকে গত হয়েছেন। আমরা একসময় এই জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের কথা বলেছিলাম। জেলা প্রশাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কাট্টলিতে। তাই পরবর্তীতে আমরা চেয়েছি, শিশুপার্কের স্থাপনা তুলে জায়গাটিতে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হোক।’
চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে চট্টগ্রামের অনন্য অবদান রয়েছে। কিন্তু এখানে ইতিহাসের স্মারক হিসেবে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এখন জায়গাটি উন্মুক্ত রেখে মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করলেই আমরা খুশি।
এ জায়গাটিতে কী করা হবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘জায়গাটি মূলত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। আর এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই আমরা প্রথমে জায়গাটি লিজ বাতিল বিষয়ে একটি চিঠি দিই। ওখানে উল্লেখ করা হয়েছিলো- মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটি খোলা রাখার শর্তে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জায়গাটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছে। তাই স্থাপনাটি সিলগালা করে জায়গাটি সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছি, ওখানে জায়গাটি উন্মুক্ত রেখে মানুষ হাঁটাচলা করার জন্য ওয়াকওয়ে এবং একটি শিখা অনির্বাণ করার প্রস্তাবনা আছে। অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’