অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »
শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে জ্ঞানচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট অঙ্গন। এই অঙ্গন গড়ে তোলে জাতির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। সামাজিক দায়িত্বপালন করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জাতির আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলক এই শিক্ষাঙ্গন যোগ্য নাগরিক উপহার দিয়ে থাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর জীবনকে সুমহান আদর্শের লক্ষ্যে পরিচালিত করে তার চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। সত্য বলা, কথা দিয়ে কথা রাখা, মানুষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতাবোধ, দয়া-করুণা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, শান্তি, মানবাধিকার, পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের মানসিকতা ও অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি সামাজিক কল্যাণমূলক ও দেশের মানোন্নয়নমূলক মানবীয় গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দেয়া হয় শিক্ষা। এই শিক্ষাদানের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে শিক্ষাঙ্গন। এ শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্রছাত্রী জ্ঞান লাভ করে নিজেকে যোগ্য ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গনের অন্তর্ভুক্ত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য।
প্রাপ্তবয়স্কদের যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা শিশুদের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। প্রতিটি শিশুর আছে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার। শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি পারিবারিকভাবে পিতামাতার মাধ্যমে হলেও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশুর প্রাথমিকভাবে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার গুণাবলী তার পরিবারের মাধ্যমেই শুরু হয়। পরিবারের, বিশেষ করে মায়ের কাছ থেকেই সে প্রাপ্ত হয় বিশেষ নৈতিক শিক্ষা। তারপরে তাকে শিক্ষা দেয় সামাজিক পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত ভাবে সেই সব শিক্ষা দেন, যা তাকে মূল্যবোধ তৈরি করতে সহায়তা করে।
শিক্ষকগণই হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকের চলাফেরা, ওঠা-বসা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সকল কিছু একজন ছাত্রের ওপর প্রভাব ফেলে, তাই শিক্ষককে সদাসতর্ক থাকতে হয় এবং ছাত্রের সুষ্ঠু মেধা বিকাশে যতœশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। কারণ একটি ফুলের বাগান তত্ত্বাবধায়কের অবহেলা কিংবা অযতেœর কারণে অনেক ফুলের কলি ঝরে যেতে পারে। তেমনি শিক্ষকের যথাযথ ভূমিকা, সহযোগিতা, তত্ত্বাবধান ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিনষ্ট হতে পারে। অপরদিকে একজন শিক্ষকের একটু উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নৈতিক মূল্যবোধের দিকনির্দেশনার ফলে ছাত্র-ছাত্রী নিজের জীবন গঠন করে শুধু দেশের নয়, সমগ্র মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে, তার শিখনকে ফলপ্রসূ এবং সর্বোপরি তাকে একজন যোগ্য মানুষ হিসবে গড়ে তুলতে। শিক্ষাকে পেশার পাশাপাশি সেবা হিসবে গ্রহণ করতে পারলেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে নিবিড় সম্পর্ক। কোমলমতি শিশুদের বকাঝকা-নির্যাতন না করে সকল শিক্ষকদের উচিত সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করা। শিশুরা সরল, অনভিজ্ঞ, খুব সহজেই নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে।
শিশুর প্রতি সব ধরণের নির্যাতন-বৈষম্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোরজবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ এর ৭০ ধারার বিধান মতে- কোন ব্যক্তি যদি তার হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোন শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন করে এবং এরূপভাবে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, পরিত্যাগ ব্যক্তিগত পরিচর্যা বা প্রদর্শনের ফলে উক্ত শিশুর অহেতুক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা স্বাস্থ্যের এরূপ ক্ষতি হয়, যাতে সংশ্লিষ্ট শিশুর দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়, শরীরের কোন অঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি হয় বা কোন মানসিক বিকৃতি ঘটে, তাহলে উক্ত অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদ- অথবা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সংঘটিত কয়েকটি অপরাধ চিহ্নিত করে তার দ্রুত বিচার ও শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। শিশুকাল যদি আনন্দময় না হয়ে ভীতিময় হয়, তাহলে সেই শিশু সারাজীবন হতাশায় ভোগে। শিশুদের প্রথম শিক্ষা শুরু হোক আনন্দ নিয়ে। আর এই আনন্দশিক্ষা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার। প্রয়োজন কোমলমতি শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যদি শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। পরিশেষে বলব- শিশুরা কখনই নির্যাতনের শিকার হবে না, এজন্য সংশ্লিষ্টদের নজর রাখা দরকার।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য খুবই প্রয়োজন। এখান থেকেই আবেগ, চিন্তা ও ভালো লাগা তৈরি হয়। সৃজনশীলতা বিকাশেও এটি দরকার। অন্যথায় তারা বিপথে যেতে পারে। প্রারম্ভিক শিক্ষায় কাউকে জোর করে আটকে রাখাটা অযৌক্তিক। সব শিক্ষার্থী সব বিষয়ে সমান দক্ষ হতে পারে না। শিশুর চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থের কথা বিবেচনা করে তাদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষার আয়োজন করা হয়, তাই শিশুবান্ধব শিক্ষা। অপরদিকে অভিভাবকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়ছে। ভাল ফল করতেই হবে- বাড়িতে অভিভাবকের অন্তহীন প্রত্যাশা, স্কুলেরও আকাক্সক্ষা সেই স্কুলের নাম ছড়িয়ে পড়বে, এমন চাপে অপরিণত মস্তিষ্ককে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে রেখে দিচ্ছে। মেধার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে শিশুদের মাঝে অনাকাক্সিক্ষত পরীক্ষাভীতি তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনার চাপের পেছনে অভিভাবকদের একটি বড় ভূমিকা থাকে। তাই তাদের সচেতন হতে হবে এবং কিছু বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে। তার ওপর যদি বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে খেলার পরিবেশ না থাকে, সর্বদা কড়া শাসন ও চাপ থাকে তাহলে তাদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। কিন্তু তারা জানে তাদের পড়ালেখা করতে হবে, এটা করতে তারা বাধ্য। শিশুদের কল্যাণের জন্যই শিক্ষা। এর প্রতি শিশুর আগ্রহ থাকাটা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। শিশু প্রতিনিয়ত শেখে। কারণ জীবনধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, নিজের চেষ্টায় এবং অন্যের সহযোগিতায় শিশুকে সবকিছু ক্রমে ক্রমে রপ্ত করতে হয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরামর্শকেন্দ্র চালু করা এবং মাঝে মধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাশের ব্যবস্থা করা দরকার। বয়স অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সময় মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের অবশ্যই শিশুবান্ধব হতে হবে। শিক্ষকদের শিশুবান্ধব পাঠদানে উপযোগী, আন্তরিক ও দক্ষ শিক্ষক প্রস্তুতের লক্ষ্যে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান আরোও ত্বরান্বিত করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ কোমলমতি শিশুদের প্রতি অধিক যত্মবান হউন। বাবা-মার কাছ থেকে যা কিছু শিখে তার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করে একজন শিক্ষকের নিকট থেকে। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে সকল পেশার মানুষের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে শিক্ষার উন্নয়নে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে কোন ভাবেই পিছিয়ে থাকার কথা নয়। শিশুদের লেখাপড়া ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের উচিত ভবিষ্যতে তাদের সুনাগরিক হবার জন্য সব প্রকার চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
লেখক : আইনজীবী