মোরশেদ তালুকদার, অভিন্ন প্রতিবেদন, সিএনএ »
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে যাত্রার সময় চট্টগ্রাম পৌরসভার আয়তন ছিল ১০ দশমিক ০৯ বর্গমাইল। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আয়তন ১৬০ দশমিক ৯৯ বর্গকিলোমিটার। সরকারি হিসেবে দীর্ঘ এ ১৬০ বছরে শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে ২০৮ গুণের বেশি। বিপরীতে দিন দিন এ শহরে কমেছে সবুজ। কমেছে উন্মুক্ত জায়গা। কমেছে মানুষের নিশ্বাস ফেলার স্থান।
চট্টগ্রাম এত পুরনো একটি শহর, অথচ এখানে নেই বড় আয়তনের কোনো উদ্যান। মাত্র ২ একর আয়তনের ছোট একটি উদ্যান আছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ ২ নম্বর গেট এলাকায়। ১৯৭৯ সালে ‘বিপ্লব উদ্যান’ নামে এর যাত্রা। নামের সঙ্গে ‘উদ্যান’ যুক্ত না থাকলে কেউ স্বীকারই করত না যে এটা উদ্যান। কারণ প্রকৃত অর্থে উদ্যানের যে বৈশিষ্ট্য তা হারিয়েছে এটি। উদ্যান মানে বাগান। এটি হবে সবুজ গাছপালায় শোভিত কোনো স্থান। যেখানে মানুষ যাবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। প্রাণভরে শ্বাস নিতে। ইট-পাথরের ঘিঞ্জি থেকে মুক্ত হয়ে সবুজ প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দিতে। বিপ্লব উদ্যানে এখন সেই সবুজ নেই। আধুনিকায়নের নামে সবুজের সিংহভাগ গিলে খেয়েছে এটির রক্ষক চসিক। অবশিষ্ট যতটুকু আছে তাও ‘বিলীন’ করার আয়োজন করছে বলে চসিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী। একইসঙ্গে নাগরিক স্বার্থ না দেখে বিপ্লব উদ্যানকে বাণিজ্যিকীকরণের আয়োজন চলছে কিনা সে প্রশ্নও তোলেন তারা।
বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ধ্বংসের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের ১ নভেম্বর স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড ও রিফর্ম লিমিটেড নামে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে করা ২০ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির পর উদ্যানে গড়ে তোলে ইট-কংক্রিটের অবকাঠামো।
নগরবাসীর অভিযোগ, সৌন্দর্যবর্ধনের পরিবর্তে উল্টো সৌন্দর্যহানি ঘটে উদ্যানটির। এখানে প্রাধান্য পায় বাণিজ্য। পার্কে নির্মাণ করা ২০টি দোকান তার প্রমাণ। বিষয়টি নিয়ে তখন আপত্তি জানান নগরবাসী। যদিও তাতে কর্ণপাত করেনি চসিক। এ অবস্থায় গত ২২ আগস্ট নতুন করে চুক্তি করে চসিক। এবার অবশ্য রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি কয়েকদিন আগে কাজও শুরু করেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ লোকজনের কেউ চান না বিপ্লব উদ্যানে আবারও অবকাঠামো নির্মাণ করা হোক। এমনকি চসিকের সাবেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও চান না এর আগে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সবুজের পরিবর্তে যে ইট-কংক্রিট জায়গা করে নিয়েছে তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাক। সবার প্রত্যাশা, উন্মুক্ত থাকুক বিপ্লব উদ্যান। ইট-পাথরের শহরের বুকে একখ- সবুজ হয়ে থাকুক এ উদ্যান। সে দাবিতে উদ্যানে নগরবাসীর পক্ষে ‘সবুজ ধ্বংস করে নতুন স্থাপনা আর নয়’ শিরোনামে ব্যানার লাগানো হয়েছে।
আইন অনুযায়ী, নগরে অবকাঠামো বা এ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমোদন নিতে হয়। তবে বিপ্লব উদ্যান সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সিডিএর কোনো অনুমোদন নেয়নি চসিক।
বিপ্লব উদ্যানে কী পরিমাণ সবুজ
দোকান ছাড়া বিপ্লব উদ্যানে বর্তমানে কংক্রিটের অবকাঠামো আছে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। দোকানসহ তার পরিমাণ ৬৫ থেকে থেকে ৭০ শতাংশ। এখানে সবুজ আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সবুজ অংশের ভিতর রয়েছে কিছু বড় গাছ এবং কিছু আর্টিফিসিয়াল গাছ ও ঘাস। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুকের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম নগরীর পার্ক ও ওপেন স্পেস’ সম্পর্কিত একটি গবেষণায় বিপ্লব উদ্যানে বিদ্যমান সবুজের চিত্রটি উঠে আসে।
অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশু জানান, বিপ্লব উদ্যানে গাইডলাইন অনুযায়ী খুবই স্বল্প পরিমাণে সবুজ রয়েছে। তাই এখানে সবুজায়নের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এখানে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো খেলার জায়গা নেই এবং খেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সামগ্রী নেই। এখানে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাবারের দোকান রয়েছে এবং তা উদ্যানের মূল জায়গা দখল করেছে। এই খাবারের দোকানগুলির উচ্ছিষ্ট ঘাসের উপর মানুষজন ফেলে, যা উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট করে এবং খাবারের দোকানের কারণে সৌন্দর্য বিঘিœত হচ্ছে। উদ্যানে অনেক বেশি পরিমাণে স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো উদ্যানের মূল জায়গাকে দখল করে রয়েছে।
সবুজ আরো কমবে?
রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সম্পাদিত চসিকের চুক্তিতে ৩১টি শর্ত রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, বিপ্লব উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলায় ২০০ ফুট দীর্ঘ স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। সেখানে হবে কফিশপ। এটা নিচতলার সাথে একাধিক সিঁড়ি দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। অবশ্য সেখানে একটি অংশে দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চসিকের উদ্যোগ, আর্থিক সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হবে এ কেন্দ্র।
এছাড়া উদ্যানের পূর্ব পাশে জাতীয় পতাকার আদলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা তৈরি একটি কাঠামো হবে। এখানে সবুজ লতাপাতা দিয়ে আবৃত করে বাংলাদেশের পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের কৃতী সন্তানদের প্রতিকৃতি থাকবে। তবে ওই কাঠামোর নিচে কিডস বা গেমিং জোন করা হবে। কাঠামোটা হেলানো অবস্থায় করা হবে। তাই পূর্ব পাশে বিদ্যমান খালি জায়গা কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে কাঠামোর ওপর, নিচ ও দুই পাশে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের লোগো প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া উদ্যানে ১ হাজার ৩০০ বর্গফুট দুটি স্টিলের কাঠামোর ভেতর গেমিং জোন করা হবে।
এছাড়া ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড বা মেগা সাইন স্থাপন করার সুযোগ আছে চুক্তি অনুযায়ী। এমনকি ডিজিটাল স্ক্রিন, মেগাসাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক, প্রদর্শনী কেন্দ্র, কিডস এক্সপেরিয়েন্স বা গেমিং জোন স্থাপন করার সুযোগ আছে।
২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী বিপ্লব উদ্যানে ফোয়ারা ও গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। নতুন চুক্তিতে ফোয়ারা ভরাটের সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে ভাঙা যাবে গ্লাস টাওয়ারও। গত সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফোয়ারা ভরাট করা হয়েছে। ভাঙা হয়েছে গ্লাস টাওয়ারও। এখন সেখানে অস্থায়ী উন্মুক্ত মঞ্চ করা হবে; যা চসিকের অনাপত্তি সাপেক্ষে বিভিন্ন অবকাশ দিবস এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসবে চত্বর ও হাঁটার জায়গায় কিয়স্ক স্থাপন করে উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যদিয়ে মূলত মানুষের হাঁটার জায়গা সংকুচিত করে মেলা বা অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন নগরবাসী।
এদিকে বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছেন বিদ্যমান দোকানদাররা। বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হূমায়ন কবির বলেন, সবুজের সংকট আছে শহরে। তাই বিপ্লব উদ্যানে দোকান নিয়ে আমরা এমনিতেই বিব্রত। এ উদ্যানে নতুন করে দোকানপাট হোক সেটা চাই না। নতুন করে দোকানপাট হলে উদ্যানে সবুজ কমে যাবে। এজন্য নতুন করে দোকানপাট নির্মাণ না করতে আমরা মেয়র মহোদয়ের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগে সবুজ ধ্বংস করা হচ্ছে বলার সুযোগ নেই। এখন তো কেবল সেখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলছে। নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করব। পতাকার আদলে কাঠামো করা হবে। কিডস জোন থাকবে। মাঠে সবুজ থাকবে।
সিডিএর অনুমোদন নেই
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, আইন অনুযায়ী নগরে কোনো স্ট্রাকচার (অবকাঠামো) করার ক্ষেত্রে সিডিএর অনুমোদন লাগে। যদি চিফ আর্কিটেক্টের অনুমোদন থাকে তখন সিডিএ থেকে নতুন করে অনুমোদন নিতে হবে না। এখানে চিফ আর্কিটেক্ট বলতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে যদি কোনো প্রজেক্ট হয় এবং সেখানে যদি চিফ আর্কিটেক্টের স্বাক্ষর থাকে তখন লাগবে না। এর বাইরে সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা বা অন্য কোনো সংস্থা যদি কোনো প্রকল্প নেয় তখন সিডিএর অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের যে অফিস ভবন করছে তার জন্য অনুমোদন নিয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন বিপ্লব উদ্যান প্রকল্পের জন্য কোনো অনুমোদন নেয়নি।
তিনি বলেন, একটি শহরে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ উন্মুক্ত জায়গা থাকা প্রয়োজন। আমাদের ১০ থেকে ২০ শতাংশও নেই। চট্টগ্রাম শহরে আগে থেকে যেসব উন্মুক্ত জায়গা ছিল সেগুলোও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমানে ঢাকার তুলনায় আমাদের উন্মুক্ত জায়গা অনেক কম। বর্তমানে যেসব উন্মুক্ত জায়গা আছে সেখানেও যদি স্ট্রাকচার করে ফেলি তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? নিশ^াস ফেলবে কোথায়? দোকানপাট করে সবুজকে নষ্ট করা উচিত না। বিপ্লব উদ্যানে আগে সুন্দর সবুজ বাগান ছিল, সেখানে মানুষ এসে বসত, নিশ^াস ফেলত। সেখানে কেবল খাবার দোকান করে মানুষকে বিনোদন দেওয়া বা ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না। শহরের উন্নয়নের সঙ্গে বা সিটি প্ল্যানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনে তো সিটি প্ল্যানার আছে। এরপরও সিটি প্ল্যানের বাইরে কিছু করা ঠিক হবে না।
বাণিজ্যিকীকরণ না করার অনুরোধ সাবেক প্রশাসকের
চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের বসার জায়গা, নিশ^াস ফেলার সবুজ প্রাঙ্গণটিকে যেন বাণিজ্যিকীকরণ না করে সে বিষয়ে মেয়রের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে। বাণিজ্যিকীকরণ করলে মানুষ কষ্ট পাবে। সিআরবির সবুজ ধ্বংস করার বিরোধিতা করেছিল মানুষ। মেয়র সাহেবও সিআরবি আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন। এখন তিনি যদি বিপ্লব উদ্যানের সবুজ রক্ষা না করেন তা মানাবে না।
কী বলছেন জেলা প্রশাসক
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ঢাকার সঙ্গে তুলনা করলে চট্টগ্রামে সবুজ উদ্যান কম। চট্টগ্রাম শহরে হাঁটাচলার জায়গা কম। ঢাকায় প্রচুর হাঁটার জায়গা রয়েছে, লেক আছে এবং বসার জায়গা আছে। চট্টগ্রামে নাগরিক এই সুবিধাগুলোর অভাব। এসব সুবিধা বাড়ানো উচিত। ওই জায়গা থেকে আউটার স্টেডিয়াম পরিষ্কার করলাম, এখন মাঠের কাজ চলছে। তিন-চার দিনের মধ্যে শিশুপার্কের স্থাপনা ভেঙে নিয়ে যাবে। এরপর সেখানে সবুজ উদ্যান গড়ে তুলব। কয়েকদিন আগে বাকলিয়া নোমান কলেজের পেছনে তিন-চার একর জায়গা উদ্ধার করলাম।
নগর পরিকল্পনাবিদরা যা বললেন
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অধ্যাক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, সিটি কর্পোরেশন বা এ ধরনের সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর উচিত মানুষের জন্য জনহিতকর এমন কাজগুলো করা, যেগুলো বেসরকারি খাতে করার সুযোগ নেই। চট্টগ্রামে উন্মুক্ত উদ্যান বা গণপরিসর দিন দিন কমে আসছে। তাই সিটি কর্পোরেশনের কাছে জনগণের আশা বা প্রত্যাশা, বিপ্লব উদ্যানকে উদ্যানের মতো রেখে জনগণের জন্য আরো সুন্দরভাবে ব্যবহার উপযোগী করা। সেখানে বাণিজ্যিকীকরণের নামে গণপরিসরের এ জায়গাকে বাণিজ্যিকভাবে বরাদ্দ দিয়ে আরো সংকুচিত করার বিরোধিতা আমরা সবসময় করে আসছি। আগেও প্রতিবাদ জানিয়েছি, এখনো একই অবস্থানে আছি। সিটি কর্পোরেশনের কাছে অনুরোধ থাকবে, বিপ্লব উদ্যানের গণপরিসর এখনো যতটুকু আছে সেখানে যেন বাণিজ্যিকীকরণের নামে অন্য কাজে ব্যবহার করা থেকে সরে আসে।
তিনি বলেন, সকলের দাবি ও আহ্বানে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের সময়ে অতিরিক্ত অংশটুকু ভেঙে দিয়ে কিছুটা শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম, হয়তো কর্পোরেশন সবার চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কাজটা করেছে। যতটুকু হয়ে গেছে ততটুকু থাক, আর যেন না বাড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ কাজটা আবার নতুন করে করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আমরা এটার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ কর্মকা- যেন স্থগিত করা হয়, সে অনুরোধ জানাচ্ছি।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন বলেন, জনগণের জন্য সবুজ যতটুকু থাকা উচিত তা নেই। বিপ্লব উদ্যানে যতটুকু সবুজ ছিল সেটা সিটি কর্পোরেশন সংকুচিত করে ফেলছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক। জনগণের জন্য সবুজায়ন বা উদ্যান পর্যায়ক্রমে কীভাবে বাড়ানো যায়, কোথায় করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিত সিটি কর্পোরেশনের। বিপরীত চিন্তা থাকা উচিত না।
তবুও আশাবাদী
নগরের ‘ফুসফুস’ খ্যাত সিআরবিতে পিপিপি প্রকল্পের আওতায় ৫শ শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল ও একশ শয্যার একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড গ্রুপ এর সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তাদের জমি বুঝিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে আপত্তি করেন নগরবাসী। প্রকল্প বাতিলের দাবিতে টানা ৪৮৩ দিন আন্দোলনের পর রেলওয়ে প্রকল্পটি বাতিল করে। ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ঘোষণা দেন, সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে না।
বেদখল হয়ে গিয়েছিল আউটার স্টেডিয়াম। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে চারপাশে গড়ে উঠে দোকানপাট। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে দখলমুক্ত হয় এটি। আউটার স্টেডিয়ামের পাশে সার্কিট হাউজ সংলগ্ন সবুজ চত্বর ছিল। প্রায় ৩ একর এই জমিতে ১৯৯২ সালে শিশুপার্ক নির্মাণে ইজারাদার নিয়োগ দেয় চসিক। পার্কটি উচ্ছেদের দাবি জানায় নগরবাসী। গণদাবি উপেক্ষা করে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি নবায়ন করে চসিক। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে পার্কটি দখলমুক্ত হয়। এর আগে পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্কে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণে উদ্যোগ নেয় চসিক। এবারও আপত্তি জানায় সাধারণ মানুষ। এখন সেখানে সবুজ উদ্যান নির্মাণ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
সিআরবি, আউটার স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক এবং জাতিসংঘ পার্কের উদাহরণ সামনে থাকায় নগরবাসী বিশ্বাস করেন রক্ষা পাবে বিপ্লব উদ্যান। পূর্বের ন্যায় সবুজে ফিরবে এ উদ্যান। নাগরিক কোলাহলের ভিড়ে আবারও দু’দ- শান্তির জায়গা হয়ে উঠবে এটি। তাছাড়া চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এর নির্দেশে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিপ্লব উদ্যানে নির্মাণ করা এক সারি বসার স্থান (দোকানের সামনে) ভেঙে দেয়া হয়। একই বছরের ১ অক্টোবর দোতলায় নির্মাণ করা দোকানও ভেঙে দেয়া হয়। তাই নগরবাসীর চাওয়া, বর্তমান মেয়রও বিপ্লব উদ্যান রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। মেয়রের হস্তক্ষেপে দূর হবে ‘আমাদের শহরে সবুজ থাকবে না’ আক্ষেপ।
সবুজ কমবে না
মেয়র, চসিক
বিপ্লব উদ্যানে বিদ্যমান সবুজের কোনো ক্ষতি হবে না বলে দাবি করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম নিউজ পেপার অ্যালায়েন্স’কে (সিএনএ) বলেন, পূর্ব পাশে বর্তমানে যে দোকানগুলো রয়েছে তার দোতলায় মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর হবে। এর সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে অবকাঠামো করা হবে। মাঠে উন্মুক্ত মঞ্চ হবে। ডাম্বেল আকৃতির কাঠামোর মধ্যে কিডস জোন হবে, বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হবে।
নতুন অবকাঠামো স্থাপন করলে সবুজের পরিমাণ কমে আসবে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, সবুজের ওপর কোনো অবকাঠমো হবে না। তাই সবুজের পরিমাণও কমবে না। বর্তমানে যে দোকানগুলো রয়েছে সেগুলো দেখা না যাওয়ার জন্য পতাকার আদলে অবকাঠামোটি করা হবে। যতটুকু জায়গা বর্তমানে সিমেন্ট দিয়ে আবৃত করা আছে সেখানেই এটা হবে। মাঠের কোথাও নতুন করে অবকাঠামো করা হবে না। বরং বর্তমানে যে চারটি ডাম্বেল আছে তা কমিয়ে দুটো করতে বলেছি।
তিনি বলেন, পুরো কাজ শেষ হলে বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্য বরং বৃদ্ধি পাবে। মানুষ এসে বসতে পারবে। ছোটখাট কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারবে। একুশে ফেব্রুয়ারি বা জাতীয় দিবসগুলোতে অনুষ্ঠান করতে পারবে।
তিনি বলেন, পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগে সবুজ ধ্বংস হচ্ছে বলার সুযোগ নেই। এখন তো কেবল রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলছে। পতাকার আদলে কাঠামো করে সেগুলো আবৃত করা হবে।
জাতীয় পতাকার আদলে হলেও মাটি বা নিচে স্পর্শ করলে কোনো অবমাননা হবে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, একদম মাটির সঙ্গে হবে তা না। এটা নিচ থেকে দেড় ফুট উঁচুতে হবে। যদি পতাকার অবমাননা হয় প্রয়োজনে সেটা আরো ওপরে করে দেয়া যেতে পারে।
মেয়র বলেন, পুরো শহরে উন্মুক্ত মাঠ এবং শিশুদের খেলাধুলার মাঠের অভাব আছে। এজন্য বিভিন্ন জায়গায় আমি কাজ করছি। চান্দগাঁওয়ে মাঠ করছি, সেটার কাজ প্রায় শেষ। বাকলিয়ায় করেছি। পাঁচলাইশের চাইল্যাতলীতে করব। সামগ্রিকভাবে চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় বিপ্লব উদ্যানকে আরো বেশি ব্যবহার উপযোগী এবং মানুষ যাতে এখানে এসে শান্তি পায়, স্বস্তি পায় তার জন্য সৌন্দর্যবর্ধন করছি।