ড. আনোয়ারা আলম»
এক সুন্দরী বিবাহিতা তরুণী – তার চরম দুঃসময়ে নির্ভরতার আশ্রয় পেল, ছোটবেলার ছেলেবন্ধুর কাছে। অবশেষে ওর জীবনের নিরাপত্তার বিনিময়ে ঋণ পরিশোধে তার সাথে লিভ টুগেদার। আমি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছায়াছবির কথা বলছি। ছবিটা তো মার মার কাট কাট হয়ে সুপার ডুপার হিট। তখন প্রশ্নটা এসেই যায় তাহলে কি আমাদের সংস্কৃতিতে লিভ টুগেদার জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে?
পারিবারিক বন্ধন – বিয়ে নামক চুক্তিতে বসবাস – সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার ধর্মপালন এসব মূল্যবোধের এক নিরব পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। তবে একুশ শতকে এসে অনেক মেয়েদের ভেতরে নানা কারণে বিয়ের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব। বরং লিভ টুগেদারে আগ্রহী অনেকে। রাজধানী শহর ঢাকায় বিশেষত সাংস্কৃতিক জগতে এই সংস্কৃতির ভেতরে ঢুকে গেছেন অনেকে।
মেরিলিন ফ্রেন্স এক জনপ্রিয় নারীবাদী লেখক তাঁর ব্রিডিং হার্ট উপন্যাসে মার্কিন নারীর জীবনে প্রেম ও প্রহসন নিয়ে যেমন লিখেছেন অন্যদিকে নারীর নিজেকে আবিষ্কার ও ভিন্ন মাত্রায় গড়ে তোলার দিক নিয়েও নাড়াচাড়া করেছেন। তাঁর লেখনীতে নারীর দ্বৈত বিড়ম্বনা, পরাধীনতা, বাইরে এসেও বন্দিত্ব, পরিচয় সংকট, পারিবারিক পিছুটান ইত্যাদি অনুষঙ্গ নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে বিবাহ পরবর্তী জীবন হচ্ছে ‘অস্বীকার, মধুচন্দ্রিমা, উদ্বেগবৃদ্ধি ও বিস্ফোরণ ’-ব্যক্তিগত ধারণা বা নিজের বলে ভাবতে পারে না অনেক নারী। অতঃপর! বিশেষত শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর ভেতরে ধীরে ধীরে বিয়ের প্রতি অনীহা।তাই নারীর বিয়ের বয়স বাড়ছে – বিয়ে বিমুখিনতাসহ বিবাহ বিচ্ছেদের সাথে লিভ টুগেদার সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ।
তবে পরিবার যেহেতু সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি, তাই বিয়ে প্রথা এক অন্যতম অনুষঙ্গ। একজন ব্যক্তির জীবনেও এটি অন্যতম এক ভূমিকা পালন করে। জগতের কোন সম্পর্ক স্বার্থহীন নয়। ডি লরেন্স এর উক্তি – জগতের কোন সম্পর্কই স্বার্থহীন না। ‘হয় বন্ধুত্ব নয় প্রেম’। বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভর বৃষ্টি’ উপন্যাসের এক অংশে যেমন – ‘ভালোবাসায় শরীরই আসল- আরম্ভ শেষ সব ওই শরীর। তাই মাঝবয়সে এসে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এতো টানাপোড়েন – এটি শরীরের কারণে – প্রকৃতির ওপর এক ধরনের প্রতিহিংসা’। বস্তুতপক্ষে দাম্পত্য জীবনে আর্থিক, সামাজিক ও শারীরিক সম্পর্কের সাথে মানসিক সম্পর্ক সমান্তরালে চলে। কিন্তু ছন্দপতন হলেই বিচ্ছেদ আর এখন লিভ টুগেদার এর প্রতি আকর্ষণ।
তবে এটি এক অশনিসংকেত সমাজের জন্য। আমাদের ঐতিহ্য পারিবারিক বন্ধন। যে সংস্কৃতির প্রতি পাশ্চাত্যের ও আকর্ষণ আছে। তবে দরকার শান্তিপূর্ণ অবস্থান। খলিল জিবরানের মতে- ‘নারী ও পুরুষের মাঝে সম্পর্কে একটা করিডর দরকার’। আধিপত্যবোধ বা অহংবোধ বা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোনভাবেই কাম্য নয়।
দাম্পত্য জীবনকে যদি ভাবা হয় একটি তানপুরা -আনাড়ি হাতে নয় – মনের আবেগে বাজাতে হবে, যাতে জীবন ভরে ওঠে মধু রাগে। আমার মতে পারিবারিক ভাঙন কোনভাবেই কাম্য নয়। এই বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে হবে। তবে দরকার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। লিভ টুগেদার নামক অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার মানসিকতার পরিবর্তন ও জেন্ডারসমতা।
শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট